Tuesday, November 17, 2015

সুন্নাহর সামগ্রিক ও ভারসাম্যময় উপলব্ধিঃ তিনটি বই পরিচিতি

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আলহামদুলিল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক রাহমাতাল্লিল আলামীন, সিরাজাম মুনিরা, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর), তার পরিবার ও সাহাবা আজমাঈনদের ওপর। আরো সালাম ও রাহমা বর্ষিত হোক ওইসব সালফে-সালেহীনদের ওপর যাদের কল্যাণকর, প্রাণান্তকর চেষ্টায় আমরা আল্লাহর দ্বীনকে বিশুদ্ধতায় পেয়েছি।

কল্যাণকর নাসিহা

কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টান্ত হলো রেইল লাইনের দুটি সমান্তরাল পথের মত। একটি থেকে বিচ্যুতি মানে অন্যটি থেকেও পদচ্যুতি। ফলে জীবনের উদ্দেশ্য যেই আল্লাহর পথে থাকার কথা, সেটা আর থাকে না। কারণ তখন আল্লাহর রাসূলের কথায় যেটা “আমাকে কুরআন ও এর অনুরপ আরেকটি জিনিস দেওয়া হয়েছে” না হয়ে সেটা হয়ে যায় “যতক্ষণ পর্যন্ত এ দু’টি বিষয়কে (কুরআন ও সুন্নাহ) দাত দিয়ে শক্ত করে আকড়ে ধরবে ততক্ষণ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হবে না” – এর বিপরীত।

যখন থেকে আমাদের মাঝে এসেছে চিন্তার দৈন্যতা, জ্ঞানের বন্ধ্যাত্বকে দিয়েছি স্বাগতম, প্রশ্নাতীত আনুগত্যের আবেগে ভেসে গেছি অতি উৎসাহে, তখন থেকেই আমরা ছিটকে পড়েছি আল্লাহর বাণীর যথার্থতা থেকে। তখন আর আমরা কুরআনে বর্ণিত “মধ্যমপন্থী জাতি” (সূরা বাকারাহ) নই, আমরা “কল্যাণের জন্য” (সুরা আলে-ইমরান) আর স্থির থাকতে পারি নি, পারিনি আমরা “ভাই-ভাই” (সূরা হুজুরাত) থাকতে আর আমাদের না আছে “দুনিয়াবী ও আখিরাতের কল্যাণ এবং আখিরাতের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি”-র (সূরা বাকারাহ) আশা। ফলে আল্লাহ আমাদেরকে যেই “খলিফার’ দায়িত্ব (সূরা বাকারাহ) দিয়ে পাঠিয়েছন, আমাদের পদস্থলনের জন্যই আমাদেরকে “ক্ষমতা” দেননি পৃথিবীতে শান্তি আনয়নের জন্য, আল্লাহর দ্বীনকে বিশুদ্ধতায় প্রচার করার জন্য (অথচ তিনি ওয়াদা করেছেন ‘লা ইয়াস্তাখলিফান্নাকুম’)।

একজন পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী হলে সে অবশ্যই এসব অবস্থার জন্য অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করবে, এ বিবেচনা হবে অন্তরকে পবিত্রতা রেখে; বিশুদ্ধ বিষয়াবলী আল্লাহর পক্ষ থেকে আসার পরে, দেখার পরে মেনে নেওয়ার ভেতর দিয়েই সেই পরিশুদ্ধ আত্মার প্রকাশ ঘটে। নতুবা হাজারও দলীল বা যুক্তি দিয়ে অপবিত্র, পক্ষপাতী মনকে বোঝানো যায় না। এটা যদি হতই তবে ইহুদি আর খৃষ্টানরা দলীল পাওয়ার পরে সাথে সাথেই ইসলাম গ্রহণ করতো। কিন্তু দলীল পাওয়ার পরেও তাদের বক্র হৃদয়ের কারণে ইসলামের সত্যতা মেনে নেয়নি (সূরা বাইয়্যিনাহ-১, সূরা বাকারাহ-২১৩)। এজন্যই আল্লাহ পবিত্রত ব্যক্তিকে সফল বলেছেন (সূরা আ’লা)।

একজন পাঠক হিসেবে এই আর্টিকেলটি পড়ার জন্য যখন প্রস্তুত হচ্ছে, আল্লাহর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাওয়াটাই কল্যাণকর। পবিত্র আত্মার সাথেই প্রশান্তি, কালবুন সালিম তারাই হবে, আল্লাহর সন্তুষ্টি তো বক্র হৃদয়ের জন্য নয়…জান্নাত তো কেবল পবিত্র হৃদয়ের জন্যই বরাদ্ধ।
আপনার কতটূকু দলীল আছে, কতটুকু আরবী জানেন, কত বিশাল-বিশাল দলীল দিতে পারেন সেগুলো আল্লাহর কাছে কোনো ধর্তব্যের মধ্যেই পড়বে না, যদি না সুন্নাহর ওপর আপনার আমল হয়, অন্তর পবিত্রতার দিক থেকে হয় পরিশুদ্ধ। আল্লাহর একটি সৃষ্টির প্রতি দয়া দেখানোর কারণেই একজন দেহপসারিণী জান্নাতে যাবে, কিন্তু একজন আলেমও জান্নাতে যাবে না অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধতার মাঝে না থাকার কারণে। সুতরাং পবিত্র হৃদয় নিয়ে, নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে দেখে যখন সত্য প্রতিভাত হয়, সেটা মানাই কল্যাণকর, কালবুন সালিমের দিকে যাওয়ার পথ তো নাজাতের রাস্তা। 

সুন্নাহ ও হাদীস নিয়ে এ যাবতকাল পর্যন্ত অনেক রেষারেষি হয়েছে এবং হচ্ছেও। মূলত সুন্নাহর সঠিক, গভীর ও ভারসাম্যপূর্ণ উপলব্ধি ব্যতীত একজন মুসলিম বিশুদ্ধ জীবন-যাপন করতে পারে না। কুরআনের ব্যাখ্যা যে সুন্নাহ সেটাও কুরআনেই আছে (সূরা নাহল-৪৪)। অথচ অনেকেই হাদীস ও সুন্নাহকে অস্বীকার করেন এমন সব যুক্তির খাতিরে যেগুলো আদতে যুক্তি বা দলীল কোনোটাই নয়; স্রেফ অপব্যাখ্যা। 

অপরদিকে আরো কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে যারা নিজেদের দুই দিকে এক্সট্রিম বা চরমপন্থি হিসেবে রয়ে গেছে। চিন্তার বৈচিত্রতা না থাকায়, অন্য স্কলারদের লেখা না পড়া বা দরকারের বাহিরে রাখায় কোনো না কোনোভাবে চরমপন্থায় চলে গেছে। একদল নিজেদের ব্যতীত অন্যদের কিছুই পড়বে না, অন্যদল যেন একেকজন একেকটি স্কলার বনে গেছে, নিজেরাই সব হাদীস থেকে ফতোয়া ও শিক্ষা বের করতে ফেলতে পারে স্কলার বা আলেমদের বাদ দিয়ে। এভাবে সঠিক মেথডলজি অনুসরণ না করার কারণে, যেকোনোভাবেই সুন্নাহর সঠিক উপলব্ধি থেকে ভারসাম্য হারিয়ে গেছে।  
 
আমরা এখানে এমন তিনটি সুন্নাহর ওপর বই পরিচিত করানোর চেষ্টা করবো, যেগুলো এমন সব স্কলার থেকে আসছে যারা সত্যিকারভাবেই স্কলার এবং ইসলামের খাতিরে ইসলামের ওপর বই লিখেছেন; দল, গোষ্ঠী বা সাংগঠনিক চিন্তার সংকীর্ণতায় আবদ্ধ থেকে নয়। সংকীর্ণতা বা আবদ্ধ জ্ঞানের পৃষ্ট থেকে উঠে সর্ব সাধারণের জন্য যারা ভারসাম্যের জন্য কাজ করেছেন, বিশুদ্ধ চিন্তার ভারসাম্য ও মধ্যমপন্থা অনুসরণ করে।
এসব বইতে পাবেন চিন্তা ও জ্ঞানের ভারসাম্য, মধ্যমপন্থী ও স্কলারলি আলোচনার আচ। এজন্য আপনি একদিকে যেমন পাবেন স্কলারদের কাজের এক গভীর উপলব্ধি, অন্যদিকে একই সাথে পাবেন ইসলামকে প্রকৃতরুপে, সত্যিকার ইসলামের মধ্যমপন্থী বর্ণনা। জীবনকে কঠিন নয় আবার শরীয়া সীমানার বাইরে একেবারে লাগামহীন সহজ বা অস্বীকারও নয়। বরং শরীয়ার পূর্ণতা, সহজতা ও ভারসাম্যপূর্ণ বিশুদ্ধ উপলব্ধিই হবে এসব বই তিনটির মৌলিক উদ্দেশ্য।
কেউ হয়তো বলতে পারেন, তিনটি বই কেন? মাওলানা আব্দুর রহীমের একটি বই-“হাদীস সংকলনের ইতিহাস” ই তো যথেষ্ট হতো বা ড. ইউসুফ আল-কারাদাওয়ীরটা হলেই তো হতো। আমি বলবো না, এদের কোনো একটা দিয়ে সুন্নাহর (১) বিস্তারিত (২) মর্যাদাগত ও উপলব্ধির মাত্রাগত মূলনীতি ও (৩) ভারসাম্যপূর্ণতার বিস্তারিত মধ্যমপন্থা আলোচনা সম্ভব নয়। এ তিনটি বিষয় পেতে হলে এই তিনটি বই-ই পড়তে হবে। তাহলেই আমরা সুন্নাহর পথের চলার জন্য উত্তম গাইডেন্স পাবো ইন শাআ আল্লাহ।

কেউ চাইলে অত্র আর্টিকেলটির পিডিএফ পড়তে পারেন, আরো সুন্দরভাবে পড়ার জন্য – http://tinyurl.com/o498ajf

ইসলামী শরীয়া ও সুন্নাহ – শাইখ ড. মোস্তফা হুসনি আস-সিবাই (রাহিমাহুল্লাহ)

গত শতাব্দীতে সুন্নাহর ওপর সর্বাপেক্ষা সেরা কাজ যদি জানতে চান তবে এটিই সেই বই। সুন্নাহ, হাদীস, এদের মর্যাদা ও শরিয়াতে এদের আইনগত অবস্থানসহ বিস্তারিত আলোচনার একটি উন্নত মানের কাজ বলতে পারেন। এটি ড.মোস্তফা হুসনি আস-সিবাই এর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীয়া বিভাগের অধীনে ১৯৪৯ সালের ডক্টরেট বা পিএইচডি থিসিস, যা পরে বই আকারে বের হয়। মূল বই আরবীতে (আস-সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা ফিত তাশরিইল ইসলামী) আর এটা ইংরেজি অনূদিত হয় (The Sunnah And Its Role In Islamic Legislation নামে)। বাংলাতেও ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনূদিত হয়েছিল (ইসলামী শরীয়া ও সুন্নাহ – নামে) কিন্তু এখন আর পাওয়া যায় না।

অন্তর্ভূক্ত বিষয়গুলো আলোচনার দিক থেকে এটি যেমন পূর্ণতার সাক্ষ্যর রেখেছে, তেমনি অতি চমৎকারিত্বের সাথে এর ক্রমধারাগত সাজানি।

sunnah oa makanatuha
মোটাদাগে বইটি তিনটি অধ্যায় ও এদের অধীনে অনেকগুলো পরিচ্ছেদে সাজানো।

প্রথম অধ্যায়ের বিভিন্ন আলোচনার মধ্য রয়েছেঃ

শাইখ বইতে হাদীস ও সুন্নাহর ঐতিহাসিক সংরক্ষ্ণের বর্ণনাসহ সুন্নাহর অর্থ, সাহাবারা কীভাবে সুন্নাহকে বুঝতেন, কীভাবে সুন্নাহকে আকড়ে ধরতেন।

বিশেষত গুরুত্বের সাথে তিনি হাদীস জালকরণ থেকে কীভাবে স্কলাররা হাদীস-সুন্নাহকে বাচিয়েছে, তাদের তৈরি মেথডলজি এবং কীভাবে সুন্নাহ ও হাদীস অবিকৃত রয়ে গেল সেই সবের বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন জাল হাদীস চিহ্নিতকরণের সাধারণ মূলনীতি ও বর্ণনাসহ। হাদীস কখন থেকে জাল হওয়া শুরু হলো, কেন শুরু হলো, খারিজিরা কেন হাদীস জাল করা শুরু করলো,ফিকহের ভিন্নতা, রাজা-বাদশাদের চাটুকারিতা ইত্যাদির সাথে হাদীস জালকরণের বিষয়াবলী আলোচনা করেছেন।

হাদীস জাল হওয়া থেকে সুন্নাহকে রক্ষার জন্য কী কী ভূমিকা নেওয়া হয়েছিল, সনদ, মতন ও হাদীসের যথার্থতা নিরুপনের জন্য কুরআন-হাদিস থেকে উতসারিত মৌলিক নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়েঃ

শতাব্দীব্যাপী হাদীসের ওপর যেসব সন্দেহ জাগিয়েছে সেগুলো, সুন্নাহর বিপরিতে শিয়া-খারিজী, মুতাজিলা ও হাদীস অস্বীকারকারীদের অবস্থান আলোচিত হয়েছে। সেই সাথে আধুনিক বিশ্বের যেসব লোকেরা হাদীস অস্বীকার করতো, তাদের অপযুক্তিগুলোকেও তিনি খন্ডিয়েছেন করেছেন।

আপনার কাছে আরেকটি দিক অবাক লাগবে যে, হাদীসের সমালোচনায় যেসব পশ্চিমারা ইসলামের ভেতরকার দুশমনদের অবস্থান দখল করেছে, তাদের সমস্ত সমালোচনার মৌলিকভাবে জবাব দিয়েছে তিনি, তাদের আধুনিক সমালোচনাকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দিয়েছে এবং সুন্নাহ ও হাদীসের মর্যাদাকে আধুনিক চিন্তা-ধারার সাথে গভীরতর উপলব্ধিতে এনেছেন।

তৃতীয় অধ্যায়ঃ

এখানে হাদীসের মর্যাদা, কুরআনের সাথে সুন্নাহর অবস্থানগত মর্যাদাশীলতা,সুন্নাহ নিজেই দলীল হতে পারে কি না, সুন্নাহতে মত পার্থক্য কেন ও কীভাবে ঘটে এসব বিষয়াদি আলোচনা করেছেন।

এরপরে কুরআন সুন্নাহকে কীভাবে ধারণ করে, কুরআন-সুন্নাহর পারস্পারিক রহিতকরণ বিষয় ইত্যাদি আলোচনায় প্রবিত্ত হয়েছেন।

সর্বশেষ পরিশিষ্টতে তিনিঃ

তিনি সম্মানিত চারজন ইমাম, তাদের প্রচেষ্টা ও জীবনীর সারাংশ উল্লেখ করেছেন নিরপেক্ষভাবে এবং এদের বিরুদ্ধে যুক্তিহীন বিরোধিতার সুন্দর জবাব দিয়েছেন। সেই সাথে হাদীসের ৬টি প্রচলিত বিশুদ্ধ কিতাবের বৈশিষ্ট ও মুহাদ্দিসদের জীবনীর ওপরও সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন।

বইয়ের স্বচ্ছতা, গবেষণার গভীরতা, বর্তমান প্রাসংগিকতা এবং স্কলারলি অ্যাপ্রোচ থাকার কারণে সুন্নাহর ওপর সারা বিশ্বের আলেমদের কাছে মৌলিক ও সেরা রেফারেন্স হিসেবে সমাদৃত। সুন্নাহর ওপর যেকোনো বইতে এটি থাকে সর্ব প্রথম মৌলিক রেফারেন্স হিসেবে।
সুসংগঠিত, বিস্তারিত, কম্প্রিহেনসিভ ও একাডেমিক অ্যাপ্রোচ থাকার কারণে সারা বিশ্বের স্ক্লারদের থেকে পেয়েছে প্রচূর প্রশংসা ও স্বীকৃতি।

ড. মোস্তফা হুসনি আস-সিবাই এর পরিচিতি


মোস্তফা হুসনি আস-সিবাই জন্মগ্রহণ করেন হামস নগরীতে, সিরিয়ার দামাস্কাতে, ১৯১৫ সালে। ছোট্ট বয়সেই কুরআনের হেফজ করেন। ইসলামি উলুম (সাইন্স)-গুলো তার পিতা শাইখ হাসানি সিবাই (রাহিমাহুল্লাহ) ও হামসের ততকালীন বিখ্যাত আলেম ও ফিকহবিদদের কাছেই শেখেন। তার পিতার অনুপস্থিতিতে শুক্রবারের জুমুয়ার খুতবা নিয়মিত দিতে থাকেন সেই আঠারো বছর বয়স থেকেই। ১৯৩৩ সালে তিনি আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিকহ বিষয়ে পড়াশুনার জন্য ভর্তি হন। ফিকহের পড়াশুনা চুকিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে উসুল আদ-দ্বীন এ ভর্তি হয়ে সেখানেও তাক লাগিয়ে দেন। শেষে ১৯৪৯ সালে শরীয়াতে সুন্নাহর অবস্থান বিষয়ে পিএইচডি করেন যা ওপরে আলোচনার বই উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি ইসলামি ফিকহ বিষয়ে ডিন ছিলেন। সাথে দামাস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীয়া ফ্যাকাল্টিতেও প্রফেসর হিসেবে ছিলেন।   

ফিকহুস সিরাহর ওপর বিখ্যাত বই The Life Of Prophet Muhammad: Highlights And Lessons এর লেখকও তিনি। এছাড়াও বিখ্যাত আরো কিছু গবেষণাধর্মী লিখিত বই রয়েছে তার (যেমন “ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী”)।

বইটির সফট কপি লিংক – http://www.kalamullah.com/the-sunnah.html



সুন্নাহর সান্নিধ্যে – শাইখ ড. ইউসুফ আলক্বারাদাওয়ী


সমকালীন শীর্ষ ইসলামী গবেষক ড.ইউসুফ আল ক্বারাদাওয়ী রচিত ‘কাইফা নাতা’আমালু মা’আসসুন্নাহ আন-নবুওয়্যাহ’ (সুন্নতে নববীকে কিভাবে বুঝতে হবে) অন্যতম মৌলিক একটি বই। ২০০৬ সালে ‘Approaching the Sunnah: Comprehension and Controversy’ (সুন্নাহ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী: সমন্বয় ও বিরোধ) শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থ্যট (IIIT) কর্তৃক। বাংলায় অনূদিত হয়ে “সুন্নাহর সান্নিধ্যে”   নামে IIT এর বাংলাদেশ শাখা BIIT থেকে। বইটি তামিল ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে। বাংলা অনুবাদটি কেমন হয়েছে জানি না, কিন্তু ইংলিশটা যথেষ্ট ভালো অনুবাদ হয়েছে। দুটোই কিনতে পাওয়া যায় আমাদের দেশে।

suunahor

সুন্নাহর উপর ড. ইউসুফ আল ক্বারাদাওয়ী বর্তমান বিশ্বের প্রথম সারির একজন স্কলার। তার পড়ালেখার বিষয় ছিল ‘উসুল আল-দ্বীন’ নিয়ে। তাঁর লেখা Approaching the Sunnah: Comprehension and Controversy সুন্নাহ বোঝার জন্য একটি অপরিহার্য বই। তিনি এ বইয়ে সুন্নাহকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এখনকার সময়ের জন্য বইটি একটি সময়োপযোগী সংযোজন। কারণ বর্তমান সময়ে উম্মাহ সুন্নাহ নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি ও বিতর্কে নিয়োজিত ও বিভক্ত। এ সংক্রান্ত জ্ঞানের অপরিসীম অভাব, কঠিন ভুল বুঝাবুঝি, ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল উপস্থাপন, পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জনের পূর্বেই সংস্কারের ভিত্তিতে পছন্দ-অপছন্দ বা মতামত নির্ধারণ ইত্যাদি উম্মাহকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। ফলে এ সময়ে এমন একটি বই সুন্নাহর ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী লাভের জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যে পরিণত হয়েছে।
অনেকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে সুন্নাহর যথার্থতাকে অস্বীকার করার প্রয়াস পান। কিন্তু ইসলামে সুন্নাহর অবস্থান ও গুরুত্ব অপরিসীম। এটাই কোরআনের একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা এবং ইসলামী শরীয়াহর দ্বিতীয় উৎস। কোরআনে সুস্পষ্টভাবে রাসূল (সা)-এর আনুগত্যকে বিশ্বাসীদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছে এবং একে বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ করেছে। কাজেই সুন্নাহর যথার্থতাকে যেমন একদিকে এড়িয়ে যাওয়া অনাকঙ্খিত তেমনিভাবে সুন্নাহকে সঠিক সামগ্রিক্ভাবে না বুঝে এর ভাসাভাসা জ্ঞানও সমাজের জন্য একটি বড় সমস্যার কারণ। এই বইয়ে সুন্নাহ বিষয়ক এসব মৌলিক সমস্যাকে তুলে ধরা হয়েছে।

বইটি তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত:

প্রথম অধ্যায়: সুন্নাহর কতিপয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন, universality (সার্বজনীনতা), coherence (সামঞ্জস্যতা), compassionate realism (সদয় দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে বাস্তবতা অনুধাবন), moderation (মধ্যমপন্থা), এবং humility (বিনয়।

দ্বিতীয় অধ্যায়: ইসলামী আইন শাস্ত্র বা নৈতিক বিধান তৈরীতে সুন্নাহর মানদণ্ড ও সুন্নাহকে ব্যবহারের পন্থা/পদ্ধতি (standards and procedures) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

তৃতীয় অধ্যায়: সুন্নাহ বোঝার ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে যে প্রচলিত ভুলগুলো করা হয় তা বিস্তারিত উদাহরণসহ বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, হাদীসের পরিপেক্ষিত বা প্রেক্ষাপট না জেনে শুধু হাদীসের টেক্সট বা মতন জানা, হাদীসের আইনগত দিক ও নৈতিক দিক (moral instruction) দু’টির পার্থক্য না বোঝা বা গুলিয়ে ফেলা, কোনটি উদ্দেশ্য আর কোনটি উদ্দেশ্য হাসিলের মাধ্যম (means and ends) তা বুঝতে না পারা, কথার ভাবার্থ আর আক্ষরিক অর্থের পার্থক্য না বোঝা (figurative and literal meaning) ইত্যাদি।

সবশেষে এ সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ নিয়ে বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে।


পুরো বইটির মধ্যে তৃতীয় চ্যাপ্টারটি খুবই গুরুত্বের দাবিদার। ইসলাম যারা বুঝতে চান বা ইসলামের জন্য কাজ করতে চান তাদের জন্য বইয়ের এ অংশটি পড়ে নেয়া খুবই জরুরী যাতে করে তারা ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ উৎস তথা সুন্নাহকে বোঝার নিয়মাবলী সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।


সুন্নাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ:

১. সুন্নাহর সমগ্রতা ও ব্যাপকতা। সুন্নাহর ব্যাপ্তি একদিকে যেমন vertically জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি তেমনি আবার horizontally এটি জীবনের সব বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। সাথে সাথে সুন্নাহর গভীরতা মানুষের চিন্তা ও ইচ্ছা পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ সুন্নাহর ব্যাপ্তি মানুষের জীবনের সকল অধ্যায় ও বিষয়কে নিয়ে।

২. সুন্নাহর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট হলো এর ভারসাম্যপূর্ণ, মধ্যমপন্থী ও পরিমিত দৃষ্টিভঙ্গী। এটি জীবনের প্রতিটি বিষয়কে ভারসাম্যপূর্ণ করে। জীবনের কোনো একটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্য বিষয়কে অবহেলা করে না। ইসলাম জীবনকে একক ইউনিট হিসাবে দেখে; জীবনের কাজকে দুনিয়াবী (secular) ও ধর্মীয় (religious)-এরূপ দুই ভাগে ভাগ করে না। আর ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টটি সুন্নাহ থেকেই পরিস্কার হয়ে উঠেছে। জীবনের প্রতি ইসলামের এই অখণ্ড দৃষ্টিভঙ্গী সুন্নাহ থেকেই বিস্তারিতভাবে বোঝা যায়।

৩. সুন্নাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো এটা সামগ্রিক, বাস্তববাদী এবং সহজ। সুন্নাহ মানুষকে একদিকে যেমন ফেরেশতা হিসাবে দেখে না তেমনি জন্মগত পাপী হিসাবেও দেখে না। সুন্নাহ জীবনকে সহজ ও সুবিধাজনক (convenient) করতে চায়। রাসূল (সা) বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ আমাকে এজন্য পাঠাননি যে, আমি সবকিছুকে কঠিন বা কষ্টকর করব; বরং তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন শিক্ষক হিসাবে এবং সহজতা আনয়নের জন্য, মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য।’ [পৃষ্ঠা- ৯]

ইউসুফ আল-কারযাভী উম্মাহর বিভিন্ন দিক ও বিষয় নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, দাওয়া, বিচার ব্যবস্থা- সব দিকেই তিনি লিখেছেন। এই বইটিতে তিনি যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন তা হলো মুসলমানদের চিন্তা প্রক্রিয়ার সমস্যা (crisis in thought process। একেই তিনি বর্তমান সময়ে মুসলমানদের সব থেকে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। লেখকের মতে, সুন্নাহ বোঝার ক্ষেত্রে (insight into the Sunnah) এবং বাস্তব জীবনে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুসলিমদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা এর একটি বড় প্রমাণ। [পৃষ্ঠা-১১]
এই পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য এটা শেখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যে, কীভাবে সুন্নাহকে বুঝতে হয় এবং কীভাবে জীবনের বাস্তবক্ষেত্রে এর ব্যবহার করতে হয়।

লেখক সুন্নাহর ক্ষেত্রে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি রাসূল (সা)-এর একটি হাদীসের মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে পাঠকদের সাবধান করেছেন। রাসূল (সা) বলেছেন, প্রত্যেক প্রজন্ম থেকে একজন ন্যায় পরায়ণ ও সত্য সন্ধানীর (just and upright) আবির্ভাব ঘটবে যিনি সুন্নাহর সঠিক জ্ঞানকে তুলে ধরবেন এবং উগ্রপন্থীদের কৃত ক্ষতি, মিথ্যা মিশ্রিতকারীদের বিচ্যুতি ও অজ্ঞ মানুষদের ব্যাখ্যা থেকে সুন্নাহকে মুক্ত রাখবেন।’
এই হাদিসে সুন্নাহের চ্যালেঞ্জ হিসাবে তিনটি গ্রুপের কৃত ক্ষতিকে দেখানো হয়েছে,

১. Extremists: এরা সুন্নাহর ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি, কঠোর ও প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করে এবং সুন্নাহর উদ্দেশ্য থেকে একে সরিয়ে ফেলে ও ক্ষতি সাধন করে। সাধারণ দৃষ্টিতে এদের এক অংশকে সুন্নাহর অভিভাবক মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে বাড়াবাড়ির কারণে এরা সুন্নাহর মূল স্পিরিট থেকে সরে পরে। অন্য প্রান্তে, বিপরীতধর্মী উগ্রপন্থীরা পুরো সুন্নাহকেই অস্বীকার করে।

২. Falsifier: এরা সুন্নাহর সাথে মিথ্যা মিশ্রিত করে, মিথ্যা হাদীস তৈরি ও প্রচার করে।

৩. Ignorant: এখানে অজ্ঞ বলতে একেবারেই হাদীস সম্পর্কে জানে না এমন গোষ্ঠিকে বোঝানো হয়নি। বরং বোঝানো হয়েছে একদল হাদীসের ব্যাখ্যাদাতা শ্রেণী যারা যথেষ্ট লেখাপড়া ও গবেষণা ছাড়াই সীমিত সংখ্যক হাদীস জেনেই এর ব্যাখ্যা দেয়; আর এসব ব্যাখ্যা দিয়ে তারা সুন্নাহর ক্ষতি করে ফেলে। তাদের স্বল্প জানা থেকে যে খণ্ডিত ব্যাখ্যা আসে তা সুন্নাহকে তার প্রকৃত স্পিরিট থেকে দূরে নিয়ে যায়। (হাদীস পাঠ, মুখস্থ করা আর হাদীসের গবেষণাভিত্তিক জ্ঞান দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।)
সুন্নাহর বিশেষ বৈশিষ্টগুলো আলোচনার পর লেখক সুন্নাহ বাস্তবায়নের কিছু মৌলিক নীতি (fundamental principles for the application of the Sunnah) আলোচনা করেছেন, যাতে মুসলমানরা নিজস্ব জ্ঞানের মাধ্যমে উগ্রপন্থীদের বাড়াবাড়ি, মিথ্যা মিশ্রিতকারীদের বিচ্যুতি আর অজ্ঞতাপূর্ণ ব্যাখ্যাগুলোর ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

সুন্নাহ উপলব্ধি বাস্তবায়নের (application)মূলনীতি:


প্রথমত, সনদ মতনের ভিত্তিতে হাদীসের শুদ্ধতা যাচাই করতে হবে। Scientific methodology অনুসারে এই যাচাইয়ের কাজ করতে হবে। হাদীসের সনদ বা বর্ণনাকারীদের পরম্পরা যাচাই যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনিভাবে হাদীসের মতন বা টেক্সট যাচাইও গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, রাসূল (সা)-এর কথা শুধু আক্ষরিক অর্থে নয় বরং ভাষার সামগ্রিক ভাবের মাধ্যমে বুঝতে হবে। তাই হাদীসের সঠিক অর্থ বুঝার জন্য ওই সময়ের পারিপার্শ্বিকতা (circumstances), ইসলামের সামগ্রিক উদ্দেশ্য (the totality of the purposes of Islam), হাদীসের সামগ্রিক উদ্দেশ্য (the general intent of hadith), আইন সংক্রান্ত ও সাধারণ (legislative and non-legislative) হাদীসের পার্থক্য- এসব বিষয় বুঝতে হবে ও বিবেচনায় আনতে হবে। [পৃষ্ঠা-২০]

তৃতীয়ত, কোনো হাদীস আরো শক্তিশালী কোনো টেক্সটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সেক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে সেই হাদীসের অর্থ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোনো হাদীসের অর্থ এমন হবে না যাতে এর থেকে শক্তিশালী কোনো টেক্সট যেমন কোরআনের আয়াত, অধিক সূত্রসমৃদ্ধ ও যাচাই-বাছাইয়ে অধিকতর প্রমাণসিদ্ধ হাদীস, ইসলামের মৌলিক নীতির সঙ্গে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ হাদীস বা ইসলামী শরীয়াহর উদ্দেশ্যের সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যশীল হাদীস ইত্যাদির সঙ্গে বিরোধ ঘটে।

লেখক এই পর্যায়ে আইন বিষয়ক ও নির্দেশনামূলক হাদীস (Legislative Sunnah and Guidance Sunnah), এই দুই ক্ষেত্রেই এর শুদ্ধতা প্রমাণিত হওয়ার উপর জোর দেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায়, অনেক মুসলিম আইন বিষয়ক হাদীসের শুদ্ধতার ব্যাপারে সচেতন থাকলেও নির্দেশনামূলক হাদীসের শুদ্ধতা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। আর এ জন্য প্রায়শ দেখা যায়, দাওয়াহ সংক্রান্ত বইগুলো (যা অন্তরকে নরম করে, আবেগকে উদ্বেলিত করে) এবং সুফিবাদ সংক্রান্ত বইগুলো মিথ্যা ও সন্দেহপূর্ণ হাদীসে ভরপুর। আবার এটাও দেখা যায়, অনেক মানুষ ভালোর জন্য বা মানুষের ভালো হবে এমন মনে করে জেনে শুনে মিথ্যা হাদীস তৈরি করে বা হাদীসকে বাড়িয়ে বলে। এ ধরনের মানসিকতাকে লেখক উদ্বেগপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন, এমন মিথ্যা হাদীস তৈরি এমন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ, যেখানে লোকেরা মনে করে আল্লাহ ধর্মকে পরিপূর্ণ করেননি বা করতে পারেননি; কাজেই এক্ষেত্রে আল্লাহকে সাহায্য করা তাদের জন্য দরকারী হয়ে পড়েছে। এটা এক ধরনের খেয়ালী, দাম্ভিকতা ও অহংকারী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

best approaching the sunnah

প্রাপ্তিস্থান: বিআইআইটি ও কাটাবনের বইঘরগুলোতেও।
বাড়ি # ০৪, সড়ক # ০২,
সেক্টর # ০৯, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০

এই পরিচিতিটা নেওয়া হয়েছে cscsbd.com থেকে। সেখানে থাকার কারণে, আর ইংরেজিতে IIIT (http://i-epistemology.net সাইটে)-তেও একই ইংরেজি রিভিউ থাকার কারণে আমি নতুন করে কিছু লেখার বা অনুবাদের প্রয়োজন বোধ করিনি। কিছুটা এডিটিসহ দিয়েছি এখানে। সিএসসিএসবিডির কাছে কৃতজ্ঞ এজন্য।

সুন্নাহর সান্নিধ্যে (বাংলা) – http://tinyurl.com/pxd47bt

IIIT (English) – http://tinyurl.com/oy4gfsy

মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সঠিকপন্থা অবলম্বনের উপায় – শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ)


ভারতগুরু মুজাদ্দিদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) সেই ব্যক্তি যিনি একাই লড়ে গেছেন সুন্নাহর পক্ষে যেখন কেউ লড়ার মত ছিলো না। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি ভারত উপমহাদেশে ইসলামী প্রত্যেকটি বিষয়াবলী আল্লাহর দেওয়ার পেছনে যে কল্যাণ (মাকাসিদ) নিহিত রয়েছে সেগুলোর অসাধারণ বর্ণনাশৈলির রুপকারক- যা তার বিশ্ববিখ্যাত বই “হুজ্জাতিল্লাহিল বালিগাহ” তে চির ভাস্বর হয়ে আছে। তিনি-ই এই বই এর লেখক।
বইটি রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর নিজের বক্তব্য নিম্নরুপঃ

“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। সালাত পেশ করছি রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর প্রতি। এক সময় আল্লাহতায়ালা আমার অন্তরে সত্য ও ন্যায়ের জ্ঞান প্রতিভাত করে দেন। ফলে উম্মাতের মুহাম্মাদীয়ার মধ্যে বিরাজিত মতপার্থক্য ও মতবিরোধসমূহের কারণ এবং আল্লাহ ও রাসূলের নিকট কোনটি সত্য-সঠিক তা আমি উপলব্ধি করতে পারি। এসব বিষয়ের এমন সহজ সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সমাধান পেশ করার যোগ্যতা ও আল্লাহ তা’য়ালা আমাকে দান করেছেন, যে ব্যাখ্যা ও সমাধান পেশ করার পর আর কোন সংশয় ও জটিলতা বাকি থাকবে না।

অতপর লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, সাহাবায়ে কিরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) এবং ইসলামী মিল্লাতের পরবর্তী মনীষীগনের মধ্যে মতপার্থক্যের, বিশেষ করে ফিকহী বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে মতপার্থক্যের কারণ কি ছিলো? আমি পরিবেশ প্রশ্নকর্তার জ্ঞান-বুদ্ধি এবং ধারণ ক্ষমতার আলোকে সেইসব সত্যের একাংশ তাদের নিকট বর্ণনা করি, যা আল্লাহতায়ালা আমার অন্তরে প্রতিভাত করে দিয়েছিলেন। এসব বিবরণ একটি পুস্তিকার রূপ লাভ করে। আমি পুস্তিকাটির নাম রাখলামঃ ‘আল ইনসাফ ফী বয়ানি আসবাবিল ইখতিলাফ।“

অনুবাদক আব্দুস শহীদ নাসিমের বর্ণনায়ঃ

“সাহাবায়ে কিরামের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) যুগ থেকেই ইসলামে ইজতিহাদী বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়ে আসছে। ইজতিহাদী  মতপার্থক্য কখনো মুজতাহিদগণের খামখেয়ালির কারণে সৃষ্টি হয়নি। বরঞ্চ ইজতিহাদ এবং মতপার্থক্যের মূল ভিত্তি ছিলো সুন্নাতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবায়ে কিরামের আছার। সাহাবায়ে কিরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম), তাবেয়ী এবং ইমাম মুজতাহিদগণের কালে মতপার্থক্য ইসলামের জন্য ক্ষতিকর কিছু ছিলো না। বরঞ্চ তখন তা ছিলো রহমত কল্যাণময়। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু লোক মতপার্থক্যকে বড় করে দেখতে থাকে। এটাকে বিদ্বেষ, গোঁড়ামী বিবাদবিসম্বাদের হাতিয়ার হিসেবে পরিণত করে। ফলে মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন দলউপদলের। অজ্ঞতাবশত এদের এক দল নিজেদের মতকেই সঠিক আর ভিন্ন মতকে বেঠিক বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করে। ফলে সত্য সন্ধানী লোকেরা পড়েন বিপাকে। সাধারণ মানুষ হয় বিভ্রান্ত।
এ ধরণের মতপার্থক্য ও মতবিরোধপুর্ণ বিষয়ে কোন্‌ মত গ্রহণীয় আর কোন্‌ মত বর্জনীয়, একজন সত্যসন্ধানী কিভাবে উভয় মতের মধ্যে সমতা বিধান এবং তা অবলম্বনের জন্যে সঠিক পন্থাটাই বা কি সে সম্পর্কে মশহুর মুজতাহিদ ও মুজাদ্দিদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলাভী (রাহিমাহুল্লাহ) তার ‘আল ইনসাফ ফী বায়ানী আসবাবিল ইখতিলাফ’ গ্রন্থে অত্যন্ত সুন্দরভাবে যুক্তিসিধ পর্যালোচনা ও সমাধান পেশ করেছেন।
গ্রন্থটি মুসলমানদের বিভিন্ন মসলকের মধ্যকার বিদ্বেষ, গোঁড়ামী, মতবিরোধ, বিবাদ বসম্বাদ ও রেষারেষী দূর করে তাদেরকে সীসাঢালা প্রাচীরের মধ্যে গ্রথিত ইটসমূহের ন্যায় মজবুতভাবে ঐক্যবদ্ধ উম্মাতে পরিণত করতে দারূণভাবে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।“
shah waliullah

বইতে আলোচিত বিষয়ের কিছুটা সারাংশ উল্লেখ করা হলো শাইখের নিজের লেখা থেকে।

সঠিক পন্থা ও সুষম নীতি

সঠিক পন্থা হলো মধ্যমপন্থা

মূল বইতে সামনের বিষয় দুটি বিস্তারিত আলোচনার পর শাইখ বলেন- উপরে যে দুটি পন্থার কথা আলোচনা করে এলাম, অর্থাৎ (১) হাদীসের শব্দের হুবহু অনুসরণ এবং (২) ফকীহদের বক্তব্য থেকে মাসয়ালা তাখরীজ (মাস’আলা বের করা) করা –এই উভয় পন্থারই দ্বীনি ভিত্তি রয়েছে। সকল যুগের মহাক্কিক আলিমগন দু’টি পন্থাই অনুসরন করে আসছেন। তবে (পার্থক্য ছিলো কেবল উভয় পন্থার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের)। অর্থাৎ তাদের কেউ তাখরীজের তরীকার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়েন আবার কেউ অধিক ঝুঁকে পড়েন হাদীসের শব্দ অনুসরণ নীতির প্রতি। (উভয় নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রতি তাঁরা কেউই মনোযোগ দেননি।) আসলে, এই দুটি পন্থার কোনো একটিকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করা যেতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত উভয় পন্থার (অর্থাৎ আহলে হাদীস ও আহলে ফিকাহর) লোকেরাই এই কাজটী করেছেন। তাঁরা একটিকে পরিত্যাগ করে অপরটির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু সঠিক পন্থা ছিলো এর চাইতে ভিন্নতর। উচিত ছিলো, উভয় তরীকাকে একত্র করে একটিকে আরেকটির সাথে তুলনা করে দেখা এবং একটিতে কোন ভুল ক্রুটি থাকলে অপরটির দ্বারা তা নিরসন করা। এ কথাটিই বলেছেন হাসান বসরী তার নিম্নোক্ত বক্তব্যেঃ

“কসম সেই আল্লাহর, যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, তোমাদের পথ হচ্ছে গালী (সীমালংঘনকারী) এবং জাফী (অপরিহার্য সীমার নিচে অবস্থানকারী) এর মাঝখান দিয়ে।”
অতএব আহলে হাদীসের উচিত, তাদের অনুসৃত ও অবলম্বিত যাবতীয় মাসয়ালা এবং মাযহাবকে তাবেয়ী এবং পরবর্তীকালের মুজতাহিদ ইমামগণের রায়ের সাথে তুলনা করে দেখা এবং তাদের ইজতিহাদ থেকে ফায়দা হাসিল করা। আর আহলে ফিকাহর লোকদেরও উচিত সাধ্যানুযায়ী হাদীসের ভান্ডারে চিন্তা ও গবেষণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা, যাতে করে সরীহ ও সহীহ হাদীসের বিপরীত মত প্রদান থেকে বাঁচতে পারেন এবং যেসব বিষয়ে হাদীস কিংবা আছার বর্তমার রয়েছে, সেসব বিষয়ে মত প্রদান থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।

মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সঠিকপন্থা অবলম্বনের উপায়


ইসলাম এসেছিল ঐক্যের পয়গাম নিয়ে। কিন্তু অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও গোঁড়ামীর কবলে পড়ে সে আজ মতবিরোধ ও ঝগড়া বিবাদের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কতিপয় ক্ষুদ্র আনুষঙ্গিক মাযহাবী মাসালাকে কেন্দ্র করে ঝগড়া বিবাদের তুফান বইয়ে দেয়া হয়েছে। এসবের কারণ নিয়ে যখনই আমি গভীরভাবে চিন্তা করেছি, দেখতে পেয়েছি, প্রতিটি গ্রুপই সত্য ও ন্যায়ের কেন্দ্র থেকে কিছু না কিছু বিচ্যুত হয়েছে। গোঁড়ামী এবং বিদ্বেষ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। প্রত্যেকেই সত্যের অনুসারী বলে দাবী করেছে। কিন্তু সত্যের একনিষ্ঠ রাজপথে চলার পরিবর্তে তারা আবেগতাড়িত হয়েছে। আমি পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের জন্যে কৃতজ্ঞ, তিনি আমাকে সঠিক সুষম ন্যায়-পন্থা জানার মানদন্ড প্রদান করেছেন। তা দিয়ে আমি সত্য ও ভ্রান্তের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছি। জানতে পারছি, সত্যের সরল সোজা রাজপথ কোনটি? আরো জানতে পারছি, লোকেরা এখন কোন ধরনের মতবিরোধসমূহের মধ্যে নিমজ্জিত? আর তাদের এস মতবিরোধ ও ঝগড়া বিবাদের ভিত্তি কি?

মুসলমানদের এই অবস্থা আমাকে দারুন পীড়া দেয়। তাই তাদের সমস্যার সঠিক ধরন তাদের সামনে তুলে ধরা দরকার। তাদের চিন্তা ও উপলব্ধির ভ্রান্তি সম্পর্কে তাদের সাবধান করা দরকার। তারা এই ভ্রান্ত পথে মুখে এবং কলিমের মাথায় যে বারাবাড়ি করছে, সে সম্পর্কে তাদের হুঁশিয়ার করা দরকার।

১. বিবাদের সবচাইতে বড় হাতিয়ারটি হলো তাকলীদ। চারজন ইমামের তাকলীদের ব্যাপারে প্রায় গোটা উম্মাত একমত। সেই প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত লোকেরা প্রায় সর্বসম্মতভাবে তাঁদের তাকলীদ করে আসছে। আর এতে যে বিরাট কল্যাণ নিহিত আছে, তাও সকলের চোখের সামনেই রয়েছে। বিশেষ করে কাল পরিক্রমায় লোকেরা যখন দ্বীনি বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা গবেষণা পরিত্যাগ করে বসেছে, নিজ মতের পিছে ছুটে বেড়াচ্ছে এবং নফসের ঘোড়ার পিছে দৌড়াচ্ছে।

তাকলীদ সম্পর্কে ইবনে হাযমের বক্তব্যঃ

“কুরআন এবং প্রাচীন আলিমগণের সর্বসম্মত মতানুযায়ী তাকলীদ হারাম এবং মুজতাহিদ ইমামগণ স্বয়ং তাঁদের তাকলীদ করতে নিষেধ করে গেছেন” লোকদের দারুণ ভুল বুঝাবুঝিতে নিমজ্জিত করেছে। তারা মনে করে বসেছে, কথাটা বুঝি সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্যেই প্রযোজ্য! কথাটি স্বয়ং সত্য কথা। তবে তা প্রযোজ্য হবে ক্ষেত্রবিশেষে। অর্থাৎ তাকলীদ নিষিদ্ধ তাদের জন্যে, যারা ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখেন অন্তত একটি মাসয়ালার ক্ষেত্রে হলেও। তাদের জন্যেও তাকলীদ করা নিষেধ, যারা সুস্পষ্টভাবে জানেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) অমুক কাজের হুকুম দিয়েছেন, অমুক কাজ নিষেধ করেছেন এবং অমুক হুকুম রহিত।’ এ জ্ঞান তারা সরাসরি হাদীস অদ্যায় করে অর্জন করুক কিংবা অর্জন করুক দ্বীনের সেরা আলিমদের আমল দেখে, তাতে কিছু যায় আসে না।

এ সত্যের প্রতিই ইংগিত করেছেন শাইখ ইযযুদ্দীন আবদুস সালাম। তিনি বলেছেনঃ
“ঐসব ফকীহদের অবস্থা দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি, যারা স্বীয় ইমামদের ইজতিহাদী ভ্রান্তি সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্বেও সেই ভ্রান্তিকে আঁকড়ে ধরে থাকে এবং তা ত্যাগ করে কিতাব, সুন্নাহ ও কিয়াসের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ মতকে গ্রহণ করে না। বরং এসব অজ্ঞ-অন্ধরা তাদের অন্ধ তাকলীদের ভ্রান্ত জজবায় অনেক সময় করে বাস্তবে কুরআন সুন্নাহর বিরুদ্ধে চলে যায় এবং স্বীয় ইমামকে ক্রটিহীন প্রমাণ করার জন্যে কুরআন সুন্নাহর এমন ভ্রান্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে যা কালামের তাহরীফ (পরিবর্তন-পরিবর্ধন) ছাড়া আর কিছু নয়।”
তিনি অন্যত্র লিখেছেনঃ
“প্রথম যুগের লোকেরা যে আলিমকেই সামনে পেতেন, তাঁর কাছেই ফতোয়া জেনে নিতেন। তিনি কোন খেয়াল ও মসলকের লোক, তা জানার চেষ্টা করতেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। চার মাযহাবের আবির্ভাব ঘটে। সেগুলোর অন্ধ অনুকরণকারীদের আগমন ঘটে। লোকেরা হিদায়াতের আসল উৎস থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল ইমামদের বক্তব্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাদের কোনো বক্তব্য যতোই দুর্বল ও দলিলবিহীন হোক না কেন। ভাবটা যেন এমন যে, মুজতাহিদরা মুজতাহিদ নন বরং আল্লাহর রাসূল, মাসূম এবং তাদের কাছে ওহী নাযিল হয়! এটা সত্য ও হকের পথ নয়। বরঞ্চ নির্ঘাত অজ্ঞতা ও ভ্রান্তির পথ।”
এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু শামাহ বলেনঃ


কেউ যদি ফিকাহর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন, তিনি যেনো কোনো একটি মাযহাবেকে যথেষ্ট মনে না করেন। বরঞ্চ প্রত্যেক মুজতাহিদের মতামত যেনো মনোযোগ দিয়ে দেখেন। প্রত্যেকের মধ্যে ডুব দিয়ে সত্যের বাতি জ্বালিয়ে দেখা উচিত। অতঃপর যে মতটিকে কুরআন-সুন্নাহর অধিকতর মনে কাছাকাছি মনে করবেন সেটাই যেনো গ্রহণ করেন। প্রাচীন আলিমগণের জ্ঞান ভান্ডারের প্রয়োজনীয় অংশগুলোর প্রতি যদি তিনি নযর দেন, তবে ইনশাল্লাহ যাচাই-বাছাইর এ শক্তি অর্জন করা তার জন্যে সহজ হয়ে যাবে এবং সহজেই শরীয়তের সত্যিকার রাজপথের সন্ধান পেয়ে যাবেন। এরূপ লোকদের কর্তব্য হলো গোষ্ঠীগত গোঁড়ামী থেকে নিজেদের মনমস্তিষ্ককে পবিত্র রাখা। বিবাদ-বিসম্বাদের ময়দানে একটি কদমও না ফেলা। কারণ সেখানে সময় নষ্ট করা এবং স্বভাব আচরণে বিকৃতি লাভ করা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। ইমাম শাফেয়ী তাঁর এবং অন্যদের তাকলীদ করতে লোকদের নিষধ করে গেছেন। একথা বলেছেন শাফেয়ীর ছাত্র আল মুযনী তাঁর গ্রন্থ মুখতাসার এর সূচনায়।

ইবনে হাযমের মন্তব্য এমন সাধারণ ব্যক্তির ব্যাপারেও প্রযোজ্য যে দ্বীনি ইলম সম্পর্কে পূর্ণাংগ না থাকার তাকলীদ করে বটে, কিন্তু কোনো একজন ফকীহর তাকলীদ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে করে যে, তিনি ভুল করে না, তিনি যা বলেন সবই সঠিক। তাছাড়া দলিল-প্রমাণের দিক থেকে তাঁর মত যতোই ভুল এবং বিপরীত মত যতোই বিশুদ্ধ হোক না কেন, সর্বাবস্থায়ই সে তাঁর তাকলীদের উপর জমে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। মূলত এ নীতি সেই ইহুদীবাদেরই অনুরূপ যা তাওহীদী আদর্শকে শিরকে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল। এ প্রসংগে একটি হাদীস উল্লেখযোগ্য। হাদীসটি মুসলিম শরীফে আদী ইবনে হাতিম থেকে বর্ণিত হয়েছে।

তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা-মাশায়েখদের রব বানিয়ে নিয়েছে।
[সূরা তাওবা আয়াতঃ ৩১]

আয়াত পড়ে বলেছেনঃ ইহুদীরা তাদের উলামা-মাশায়েখদের ইবাদাত করতো না বটে, কিন্তু তারা যখন কোনো জিনিসকে বৈধ বলতো। তারা সেটাকেই (নির্বিচারে) বৈধ বলে গ্রহণ করতো আর তারা তাদের জন্যে যেটাকে নিষিদ্ধ করতো, সেটাকেই অবৈধ বলে মেনে নিতো।”

সুতরাং এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো একজন মাত্র ইমাম এর তাকলীদ করা যে, তিনি শরীয়তের নির্ভুল মুখপাত্র—তার পূজা করারই সমতুল্য।
ঐ ব্যক্তির ব্যাপারেও ইবনে হাযমের ফতোয়া প্রযোজ্য যে মনে করে, কোনো হানাফীর জন্যে শাফেয়ী ফকীহর কাছে এবং কোনো শাফেয়ীর জন্যে হানাফী ফিকাহর নিকট ফতোয়া চাওয়া বৈধ নয়, কিংবা হানাফীর জন্যে শাফেয়ী ইমামের পিছে এবং শাফেয়ীর জন্যে হানাফী ইমামের পিছে (নামাযে) ইক্তেদা করা বৈধ নয়। এটা সাহাবী, তাবেয়ী ও উলামায়ে সলফের কর্মনীতির সুস্পষ্ট বিরোধিতা। এরূপ চিন্তা ও কর্ম কোনো অবস্থাতেই বৈধ হতে পারে না।
কিন্তু এরূপ বিশুদ্ধ ঈমান-আকীদার অধিকারী হওয়া সত্বেও যেহেতু সে কুরআন-হাদীস সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে না, বিরোধপূর্ণ হাদীসসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের যোগ্যতা রাখে না এবং কুরআন-হাদীসের ভিত্তিতে মাসায়েল ইস্তিম্বাতের (উদ্ঘাটনের) যোগ্যতা রাখে না, সেহেতু সে যদি তার দৃষ্টিতে সুন্নাতের রাসূলের ভিত্তিতে ফতোয়া দেবার উপযুক্ত নির্ভরযোগ্য কোনো আলিমের ইক্তেদা-অনুসরণ করে এবং মনে এই চিন্তা রাখে যে, যখনই সে আলিমের কোনো ফতোয়া কুরআন সুন্নাহর প্রমাণিত দলিলের বিপরীত দেখতে পাবে, তখনই তা ত্যাগ করবে, কোনো প্রকার গোঁড়ামী করবে না, এরূপ ব্যাক্তির জন্যে তাকলীদকে কিছুতেই অবৈধ বলা যেতে পারে না। 


কারণ, রাসূলুল্লাহর সে যুগ থেক নিয়ে আজ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে ফতোয়া চাওয়া এবং ফতোয়া দেয়ার নিয়মই অবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে। সুতরাং এই নীতিতে আমল করার পর এক ব্যাক্তির কাছে সবসময় ফতোয়া কিংবা বিভিন্ন ফকীহর নিকট বিভিন্ন সময় ফতোয়া চাওয়া উভয়টাই বৈধ। এটা কেমন করে অবৈধ হতে পারে? কারণ আমি তো কোনো ফকীহর ব্যাপারে এরূপ ঈমান পোষণ করি না যে, তাঁর নিকট আল্লাহ তায়ালা ফিকাহ সংক্রান্ত ওহী নাযিল করেন, তাঁর ইতায়াত করা আমার জন্যে ফরয এবং তিনি নিষ্পাপ। আমি যখন কোনো ফকীহর ইক্তেদা করি, তখন তার সম্পর্কে ধারণা নিয়েই তাঁর ইক্তেদা করি যে, তিনি কুরআন সুন্নাতে রাসূলের একজন আলিম। সুতরাং তাঁর বক্তব্য কুরআন সুন্নাহ মুতাবিকই হবে। হয় সরাসরি কুরআন হাদীস দিয়েই কথা বলবেন, কিংবা কুরাআন হাদীসের ভিত্তিতে ইস্তিম্বাত করে কথা বলবেন।

২. তাকলীদের পর মুসলমানদের মধ্যে সবচাইতে বড় সমস্যার কারণ হয়েছে কুরআনহাদীসের শাব্দিক অনুসরণ এবং ইস্তেখরাজ।

এখানে দু’টি নিয়ম রয়েছে। একটি হলো, হাদীসের শাব্দিক অনুসরণ। আর দ্বিতীয়টি হলো, মুজতাহিদ ইমামদের প্রণীত উসূলের  ভিত্তিতে মাসায়েল ইস্তিম্বাত করা। শরয়ী দিক থেকে এই দু’টি নিয়মই সর্বস্বীকৃত। সকল যুগের বিজ্ঞ ফকীহগণ দু’টি বিষয়ের প্রতিই গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তবে কেউ একটির প্রতি অধিক মনোনিবেশ করেন, আবা কেউ অপরটির প্রতি বেশী যত্মবান হন। কিন্তু কোনো একটিকে সম্পুর্ণ পরিত্যাগ কেউ করেননি। সুতরাং হক পথের কোনো পথিকেরই কেবল একটি মাত্র পন্থার প্রতি সম্পূর্ণ ঝূঁকে পড়া উচিত নয়। অথচ দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এই প্রবণতাই তাদের গোমরাহীর জন্যে দায়ী। এই দু’টি পন্থার একটিকে বাদ দিয়ে কোনো একটি দ্বারা হিদায়াত এর রাজপথের সন্ধান পাওয়া খুবই দুষ্কর। সঠিক নীতি হচ্ছে, উভয় পন্থাকে পৃথক করে না দিয়ে উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা। একটি দ্বারা আরেকটির কাঠামোকে আঘাত না করে একটির সাহায্যে আরেকটিকে ক্রটিমুক্ত করা। কেবল এভাবেই অটল মজবুত ভিতের উপর দ্বীনী বিধানের এক দুর্ভেদ্য প্রাসাদ নির্মিত হতে পারে। এভাবেই তাতে কোনো ভ্রান্তির প্রবেশ পথ বন্ধ হতে পারে। এ নীতির প্রতিই আমাদেরকে অংগুলি নির্দেশ করে দেখিয়েছেন হাসান বসরীঃ

“আল্লাহর কসম, তোমাদের পথ হচ্ছ, সীমা থেকে দূরে অবস্থান এবং সীমাতিক্রম—এ দূটির মাঝখানে।”

৩. তৃতীয় যে জিনিসটি মুসলমানদের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে, তা হলো শরয়ী বিধান জানার জন্যে কুরআন সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণঅনুকরণগত তারতম্য।

শরয়ী বিধান অবগত হবার জন্যে কুরআন ও হাদীসের যে অনুসরণ করা হয়, তার মধ্যে মাত্রাগত পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম মর্যাদা হলো, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে শরয়ী বিধানসমূহ সম্পর্কে এতোটা বিজ্ঞতা অর্জন করা, যাতে করে প্রশ্নকর্তাদের প্রায় সমস্ত প্রশ্নের জবাব অতি সহজেই দেয়া যায় এবং মানব জীবনে সংঘটিত সকল ঘটনাবলীর শরয়ী সমাধান অবগত হবার জন্যে তার অনেক দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়, অনেক নীরবতা অবলম্বন করতে হয়। এটা হচ্ছে ইজতিহাদের মর্যাদা। আর এর যোগ্যতা অর্জন করার কয়েকটি পন্থা রয়েছে যা তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন বইতে।

‘ইয়াকুত ও জাওয়াহেরে’ উল্লেখ আছে, আবু হানীফা (রহ) বলতেনঃ

“আমার মতের পক্ষে গৃহীত দলিলসমূহ যার জানা নেই আমার মতানুযায়ী ফতোয়া দেয়া তার উচিত নয়। আবু হানীফা স্বয়ং কোনো ফতোয়া দেয়ার সময় বলতেনঃ “এটা নুমান বিন সাবিতের (অর্থাৎ আমার) মত। আমার নিজের বুঝ-জ্ঞান আনুযায়ী আমি এটাকেই উত্তম মনে করি।”

ইমাম মালিক (রহ) বলেনঃ

“রাসূলুল্লাহ (সা) ছাড়া এমন কোনো মানুষ নেই, যার পুরো বক্তব্য গ্রহযোগ্য হতে পারে। তিনি ছাড়া আর সকলের বক্তব্যের কিছু অংশ গ্রহণযোগ্য এবং কিছু অংশ বর্জনীয়।”

হাকিম ও বায়হাকীতে বর্ণিত হয়েছে, শাফেয়ী (রহ) বলতেনঃ

“কোনোঃ বিষয়ে সহীহ-বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া গেলে সে বিষ্যে সেটাই আমার মত।”

অপর একটি বর্ণনায় রয়েছে, শাফেয়ী (রহ) বলেছেনঃ

“তোমরা যখন আমার কোনো মতকে হাদীসের সাথে বিরোধপূর্ণ দেখতে পাবে, তখন তোমরা হাদীসের ভিত্তিতে আমল করবে এবং আমার মতকে দেয়ালের ওপাশে নিক্ষেপ করবে।”
শাফেয়ী (রহ) একদিন ইমাম মুযনীকে লক্ষ্য করে বলেনঃ “হে আবু ইব্রাহীম! আমার প্রতিটি কথার অন্ধ অনুকরণ (তাকলীদ) করো না। বরঞ্চ সে বিষয়ে নিজেও চিন্তা-গবেষণা করা উচিত। কারণ, এটা যা-তা ব্যাপার নয়, দ্বীনের ব্যাপার।”

তিন আরও বলতেনঃ

“রাসূলুল্লাহ (স) ছাড়া আর কারো কথার মধ্যে কোনো হুজ্জত নেই, তাদের সংখ্যা যদি বিরাটও হয়।”

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) বলতেনঃ

“আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার সাথে বিরোধপূর্ণ হলে কোনো ব্যাক্তির কথাই গ্রহণযোগ্য নয়।”

তিনি এক ব্যক্তি কে বলেছিলেনঃ

“আমার তাকলীদ করো না। মালিক, আওযায়ী, ইব্রাহীম নখয়ী প্রভৃতি কারই তাকলীদ করো না। তারা যেমন কিতাব ও সুন্নাহ থেকে মাসয়ালা গ্রহণ করেছেন, তোমরাও অনুরূপভাবে কুরআন ও সুন্নাহ থেকেই মাসয়ালা গ্রহণ করো। সকল ইমামের মাযহাব ও মতামত সম্পর্কে অবগত হওয়া ছাড়া কারোই ফতোয়া দেয়া উচিত নয়। কারো নিকট যদি এমন কোনো মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করা হয়, যেটির বিষয়ে স্বীকৃত ইমামগণ একমত পোষণ করেছেন সেটির সেই সর্বসম্মত জবাবটি বলে  দেয়াতে কোনো দোষ নেই। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে সেটা তার নিজস্ব মতামত নয়, বরঞ্চ ইমাম-মুজতাহিদ্গণের মতেরই ভাষ্য বলে গণ্য হবে। তার নিকট যদি কেউ কোনো মতবিরোধপূর্ণ মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করে, সেক্ষেত্রে এটা অমুকের মতে জায়েজ আর অমুকের মতে নাজায়েজ জবাব দেয়াতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু এরূপ ক্ষেত্রে এক পক্ষের মত বলে দেয়া উচিত নয়।”

ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) এর বিখ্যাত দু’জন ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম যুফার (রহ) প্রমুখ বলেছেনঃ

“এমন কোনো ব্যক্তির আমাদের মত অনুযায়ী ফতোয়া দেয়া উচিত নয়, যিনি আমাদের মতের ভিত্তি সম্পর্কে অবগত নন।”

ইমাম আবু ইউসুফকে বলা হয়ঃ ‘আবু হানীফার সাথে আপনার ব্যাপক মতপার্থক্য লক্ষ্য করছি।‘ তিনি তাকে জবাবে বলেনঃ “এর কারণ, আবু হানীফাকে যতোটা বুঝ-জ্ঞান দেয়া হয়েছে, ততোটা আমাদেরকে দেয়া হয়নি। তিনি তাঁর বুঝ জ্ঞানের মাধ্যমে যা অনুধাবন করেছেন, তার সবটা বুঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাঁর যে বক্তব্য আমরা উপলদ্ধি করতে পারি না, তা দিয়ে ফতোয়া দেয়া আমাদের জন্যে বৈধ হতে পারে না।”

ইবনুস সিলাহ বলেছেনঃ “শাফেয়ী মাযহাবের কোনো ব্যক্তির নজরে যদি এমন কোনো হাদীস পড়ে, যেটি শাফেয়ীর মতের সাথে সাংঘর্ষিক, এরূপ ক্ষেত্রে তিনি যদি ইজতিহাদের মতলকের অধিকারী হন কিংবা সেই বিষয় বা মাসয়ালাটি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হন, তবে বিষয়টি সম্পর্কে গবেষোণা করার পর হাদীসটি বিশুদ্ধ প্রমাণিত হলে, সেক্ষেত্রে হাদীসটির উপর আমল করা এবং তাকলীদ পরিহার করা তাঁর জন্যে জরুরী। আর তিনি যদি এরূপ যোগ্যতার অধিকারী না হন আর দেখেন যে, অপর কোনো ইমাম এর মত হাদীসটির অনুরূপ। সে ক্ষেত্রেও হাদীসটির উপরই আমল করা তাঁর জন্য জরুরী। কারণ, এতে করে তাঁর কোনো না কোনো ইমামের তাকলীদ করা হয়ে যাচ্ছে।”—ইমাম নববীও এ মতই পোষণ করেন।

৪. চতুর্থ সমস্যাটি সৃষ্টি হয়েছে ফকীহদের পারস্পরিক মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে। অথচ ফকীহদের মধ্যে তো মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেসব বিষয়ে, যেসব বিষয়ে স্বয়ং সাহাবায়ে কিরামের (রা) নিকট থেকেই পার্থক্যপূর্ণ মত (ইখতেলাফ) পাওয়া গেছে। যেমনঃ তাশরীক ও দুই ঈদের তাকবীর, মুহরেমের (যিনি ইহরাম বেধেছেন) বিয়ে, ইবনে আব্বাস ও ইবনে মাসউদের (রা) তাশাহুদ, বিসমিল্লাহ এবং আমীন সশব্দে কিংবা নিঃশব্দে পড়া প্রভৃতি বিষয়ে। এসব ক্ষেত্রে তাঁরা একটি মতকে আরেকটি মতের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন মাত্র।

অতীত আলিমগণের মতপার্থক্য মূল শরীয়তের ব্যাপারে ছিলো না। মতপার্থক্য হয়েছে আনুসঙ্গিক বিষয়াদিতে। আর সেসব মতপর্থক্যও ছিলো নেহাতই সাধারণ ধরণের। মতপার্থক্য ছিলো দু’টি বিষয়ের মধ্যে কোনটি উত্তম, তাই নিয়ে। কেউ মনে করেছেন এটি উত্তম, আবার কেউ মনে করেছেন ওটি উত্তম। যেমন, কারীগণের কিরআতের পার্থক্য। বিভিন্ন কারী বিভিন্ন দৃষ্টিভংগিতে তিলাওয়াত করেন। একই শব্দ বা আয়াত এর তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে তুমি তাদের মধ্যে বেশ পার্থক্য দেখতে পাবে। ফকীহদের  মতপার্থক্যের ধরনও অনুরূপ। ফকীহগণ তাঁদের মতপার্থক্যের কারণ হিসেবে বলেছেন, এই মতও সাহাবীদের থেকে পাওয়া গেছে, ঐ মতও সাহাবীগণের (রা) নিকট থেকে পাওয়া। অর্থাৎ তাদের মধ্যেও পারস্পরিক মতপার্থক্য ছিলো এবং তা সত্বেও তাঁরা সকলেই হিদায়াতের উপর ছিলেন। এ কারণে হকপন্থী আলিমগণ ইজতিহাদী মাসায়েলের ক্ষেত্রে সকল মুজতাহিদের ফতোয়াকেই জায়েজ মনে করেন, সকল কাযীর ফায়সালাকেই স্বীকার করেন এবং অনেক সময় নিজ মাযহাবের বিপরীত মতের উপরও আমল করেন। এ কারণেই তুমি দেখতে পাচ্ছো, তারা মাসয়ালার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং ইখতেলাফী দিকসমূহ আলোচনার পর বলে দেন, ‘আমার মতে এটাই উত্তম’, ‘আমার মতে এটা গ্রহণ করা ভালো’। আবার কখনো বলেনঃ ‘আমি কেবল এতোটুকুই জানতে পেরেছি।‘ ‘আল মাসবূত’ আছারে মুহাম্মাদ এবং শাফেয়ীর বক্তব্যের মধ্যে এ কথাগুলোর সাক্ষ্য তুমি দেখতে পাবে।
অতঃপর শুভবুদ্ধির অধিকারী দ্বীনের সেই মহান খাদিমদের কাল অতিক্রান্ত হয়। তাদের পরে এমনসব লোকের আগমন ঘটে, যারা সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগির অধিকারী হবার কারণে হিংসা-বিদ্বেষ ও বিবাদের ঝড় বইয়ে দেয়। মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়গুলোর কোনো একটিকে আঁকড়ে ধরে। এ মতের অধিকারীদের এক পক্ষ আর ঐমতের অধিকারীদের আরেক পক্ষ থেকে। এভাবেই শুরু হয় ফিরকা-পুরস্তী। এতে করে মানুষের মধ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে পড়ে তাহকীক ও চিন্তা গবেষণার জজবা। তারা নিজ নিজ ইমামের মাযহাবকে আকড়ে ধরে অন্ধভাবে। আফসোস তাদের এই অবস্থার জন্যে!
অথচ এইসব মতপার্থক্যপূর্ণ বিষয়ে সাহাবী, তাবেয়ী ও তাদের পরবর্তী মহান আলিমগণের অবস্থা দেখো! তাঁরা (নামাজে) কেউ বিসমিল্লাহ পড়তেন, আবার কেউ পড়তেন না। কেউ তা সশব্দে পড়তেন, আবার কেউ নিঃশব্দে পড়তেন। কেউ ফজরে দোয়ায়ে কুনুত পড়তেন, আবার কেউ তা পড়তেন না। কেউ নকসীর, বমি ও ক্ষৌরকার্য করার পর অযু করতেন, আবার কেউ করতেন না। কেউ কামনা সাথে স্বীয় লিংগ এবং স্ত্রীকে স্পর্শ করলে অযু করতেন, আবার কেউ করতেন না। কেউ রান্না করা খাদ্য খেলে অযু করতেন আবার কেউ করতেন না। তাদের কেউ উটের  গোশত খেলে অযু করতেন আবার কেউ করতেন না।
এতদসত্বেও তাঁদের একজন অপরজনের পিছনে নামাজ পড়তেন। যেমন, আবু হানীফা ও তাঁর সাথীরা এবং শাফেয়ী প্রমুখ মদীনার ইমামদের পিছনে নামাজ পড়তেন। অথচ তাঁরা ছিলেন মালিকী অন্যান্য মতের লোক এবং তাঁরা সশব্দে কিংবা নিঃশব্দে বিসমিল্লাহও পড়তেন না। ইমাম আবু ইউসুফ হারুনুর রশীদের পিছে নামাজ পড়েছেন। অথচ হারুনুর রশীদ ক্ষৌরকার্য করার পর নতুন করে অযু করতেন না। কারণ ইমাম মালিক (রহ) ফতোয়া দিয়েছেন, ক্ষৌরকার্য করার পর অযু করার প্রয়োজন নেই। আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) ক্ষৌরকার্য এবং নকসীর৮২ এর জন্যে অযু করার কথা বলেছেন।

[৮২. গরমের প্রকোপে নাক দিয়ে যে রক্ত বের হয়, তাকে নকসীর বলে। –অনুবাদক]

কিন্তু যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ “যদি ইমামের শিরীর থেকে রক্ত বের হয় আর তিনি অযু না করেন, তবে কি আপনি তার পিছে নামাজ পড়বেন?” জবাবে তিনি বললেনঃ ‘কেমন করে আমি মালিক ও সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেবের পিছে নামাজ না পড়ে থাকতে পারি?’৮৩
 [৮৩. এ দু’জনের মতে এটা অযু ভঙ্গের কারণ নয়। –অনুবাদক]

বর্ণিত আছে, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ উভয়েই ঈদে ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত আকবীরের অনুসরণ করতেন। হারুনুর রশীদের পছন্দের কারণে তাঁরা এটা করতেন। অথচ তাঁরা ইবনে মাসউদ বর্ণিত তাকবীরের অনুসারী।

একবার শাফেয়ী আবু হানীফার কবরের কাছাকাছি স্থানে ফজরের নামাজ আদায় করেন। এ সময় আবু হানীফার সম্মানার্থে তিনি ফজরের নামাজে দোয়ায়ে কুনুত পড়েননি। তিনি বলতেন, আমি অনেক সময় ইরাকবাসীদের (আবু হানীফার) মাযহাবের উপর আমল করি।

ইমাম খানজাদীকে শাফেয়ী মাযহাবের এমন এক ব্যাক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, যে ব্যাক্তি এক বা দুই বছরের নামাজ ছেড়ে দিয়েছিল, অতঃপর আবু হানীফার মাযহাব গ্রহণ করে। এখন সে কোন মাযহাবের রীতিতে নামাজগুলো কাযা করবে? শাফেয়ী মাযহাবের রীতিতে নাকি হানাফী মাযহাবের রীতিতে? জবাবে ইমাম খানজাদী বলেনঃ “সে বৈধ মনে করে, এমন যে কোনো মাযহাবের রীতিতে পড়লেই নামাজ আদায় হয়ে যাবে।”

কোনো হানাফী মাযহাবের লোক যদি শপথ করে যে, ‘আমি যদি অমুক মহিলাকে বিয়ে করি, তবে তাকে তিনি তালাক দিলাম।’৮৪

[৮৪. উল্লেখ্য, হানাফী মাযহাব অনুযায়ী এভাবে শপথ করলে সেই মহিলাকে বিয়ে করার সাথে সাথে তার উপর তিন তালাক প্রযোজ্য হয়ে যাবে। –অনুবাদক]

অতঃপর কোনো শাফেয়ী আলিমের নিকট ফতোয়া চাইলে তিনি যদি বলেনঃ ‘তালাক হয়নি, তোমার শপথ বাতিল, সেটা ছিলো একটা বাহুল্য কথা।’ এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে সে যদি শাফেয়ী মাযহাবের অনুসরণ করে, তবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ, এর পক্ষে বিরাট সংখ্যক সাহাবীর মত রয়েছে। এ কথাগুলো উল্লেখ হয়েছে ‘জামিউল ফাতাওয়া’ গ্রন্থে।
ইমাম মুহাম্মাদ (রহ) তাঁর ‘আমালী’ গ্রন্থে বলেছেনঃ “কোনো ফকীহ যদি তার স্ত্রীকে বলে, ‘তোমাকে তালাক দিয়ে দিলাম’ এবং তার মাযহাব অনুযায়ী সে যদি এটাকে তিন তালাক বা বায়েন তালাক মনে করে, কিন্তু সমকালীন কাযী যদি সেটাকে তালাকে রিজয়ী (ফেরতযোগ্য) বলে ফায়সালা দেয়, তবে তার স্ত্রীর  সাথে ঘর করার অবকাশ তার রয়েছে।”

একইভাবে হালাল হারাম, লেনদেন ও পারস্পরিক সম্পর্কের সেইসব বিষয়ে, যেগুলোর ব্যাপারে ফকীহদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে, প্রত্যেক ফকীহর উচিত সেসব বিষয়ে ইসলামী আদালত তার মাযহাবের বিপরীত রায় দিলেও সে রায়ের উপর আমল করা এবং সেসব ক্ষেত্রে স্বীয় মাযহাবের উপর আমল না করা।

আলোচনাকে অন্যন্ত দীর্ঘায়িত করলাম। যেসব কারণে বিভিন্ন মাযহাব ও দল উপদলের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ লেগে আছে, সেগুলোর কারণ উদ্ঘাটিত করা এবং সত্য ও সঠিক পথের দিশা দেয়াই এ দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্য। কেউ যদি বিদ্বেষী এবং অতি সংকীর্ণ ও অতি উদার মনোভাব থেকে মুক্ত হয়ে ন্যায় ও সত্যানুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে এ কথাগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেয়, তবে সত্য ও সঠিক পথের অনুসরণের জন্যে এ কথাগুলোই তার জন্যে যথেষ্ট। আর প্রকৃত সত্য সম্পর্কে তো আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।“

শাইখ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) এর মূল গ্রন্থটি আরবী ভাষায় লিখিত। খ্যাতনামা আরব আলিম আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ সম্পাদিত এবং বৈরুতের ‘দারুন নাফায়েস’ কর্তৃক প্রকাশিত ১৯৮৪ ঈসায়ীতে মুদ্রিত গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ এবং ভারতের খ্যাতনামা আলিম মাওলানা সদরুদ্দীন ইসলাহী কর্তৃক অনূদিত উর্দূ – এই দুটিকে সামনে রেখেই এই বাংলা অনুবাদ সম্পাদনা করা হয়েছে ।

মতবিরোধকে মিটাতে, এতে ভারসাম্য আনতে, উম্মাতে মুহাম্মাদিকে একই রজ্জুতে দৃঢ়তার সাথে দাড়াতে, এই বইয়ের বিস্তারিত বর্ণনা আমাদেরকে শান্তি পথ দেখায়, মধ্যমপন্থা দেখায়, দেখায় কীভাবে মত পার্থক্য এড়িয়ে, বা সুষম করে, ভারসাম্য এনে আমাদেরকে একই উম্মাতের ভাই-ভাই হিসেবে বিশ্বে অবদান রাখার মত একটি দেহে রুপান্তরিতকরণের রুপ দেয়।

‘বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার’ কর্তৃক প্রকাশিত, কাটাবন মসজিদ সেন্টার।
সফট কপি লিংক – http://tinyurl.com/ogw6q89




শেষোক্তি: পথের সন্ধানে….


তিনট বই থেকে আপনি সুন্নাহ-হাদীসের ওপর পাচ্ছেন স্কলারদের লিখিত (১) বিস্তারিত এবং (২) ভারসাম্যপূর্ণ সুন্নাহর উপলব্ধি যা ইসলাম পালনে বিশুদ্ধতম, মর্যাদাপূর্ণ ও ভারসাম্যময় মধ্যমপন্থায় চলার পাথেয় হিসেবে সংগী হয়ে থাকবে জ়ীবন্ত হয়ে।

এই তিনটি বই পড়ে নিলে আপনি পথে চলতে বাধাপ্রাপ্ত হলেও আলো হয়ে সম্মুখে থাকবে উজ্জ্বল হয়ে, আপনি পথ হারাবেন না ইন শাআ আল্লাহ। এসব স্কলারদের উন্নত গবেষণাধর্মী, ভারসাম্যপূর্ণ, মধ্যমপন্থী ও একাডেমিক আচের কারণে আপনি সঠিক পথের দিশা পাবেন বিশুদ্ধতম আখলাকের দালিলিক ভিত্তিতেই। এখানে দু’লেভেলের প্রান্তিকতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষকে ছাড়িয়ে সুন্নাহকে বিশুদ্ধভাবে উপলব্ধির মাধ্যমে সিরাতাল মুস্তাকিমের পথ পাবেন। পাবেন তিনজন আলেমের সুন্নাহভিত্তিক বর্ণনায় রাসূলের দেখানো মধ্যমপন্থায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পথে চলার বিশুদ্ধতম দ্বীনের মূলনীতিগত বর্ণনা।
মা’আস সালাম।

লেখায় যেকোনো ভুল-ভ্রান্তির জন্য সাজেশন দিতে পারেন এখানে –
www.alsabanow13@gmail.com