বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম
আমরা ইন্টারনেটের এমন বিশ্বে বসবাস করছি যা আইফোন, আইপ্যাড, মাইস্পেস এবং ইউটিউব এর মত অসংখ জিনিস আমাদের ঘিরে রেখেছে। যার স্পষ্ট ফোকাস হল- Me, my, I. এই ‘নিজেকে’ নিয়ে আচ্ছন্ন হওয়া দেখতে বেশি দূরে তাকাতে হয় না। যেমন টেলিভিশনের অনেক এডভারটাইজমেন্ট ই আমাদের নিকট এমনভাবে আবেদন রাখে যেন আমরা তাদের ভালোবাসি, তাদের ক্ষমতা স্বীকার করি। তারা এভাবে এগুলোর প্রদর্শন করে যেন আমরা তাদের শাসন করি অথচ অবচেতনভাবে যেন আমরাই তাদের দ্বারা শাসিত হচ্ছি, তাদের ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছি প্রতিনিয়ত অথচ আমরা উপলব্ধিটুকু করতেও ব্যর্থ হচ্ছি।
কিন্তু এডভভারটাইজ ই শুধু আমাদের অহংবোধের কাছে আপিল করে না বরং সমস্ত বিশ্বেই এমন অনেক প্রপঞ্চ রয়েছে যা অহংবোধ (Ego) এর জন্য প্ল্যাটফর্ম ও প্রয়োজনীয় স্থান হিসেবে কাজ করে। এখন এটার একটা প্ল্যাটফর্ম এই ফেইসবুক। কিন্তু আমি স্পষ্টভাবে বলতে পারি যে ফেইসবুক অবশ্যই কল্যাণের জন্য একটা শক্তিশালী হাতিয়ার। অন্যান্ন জিনিসের মত এটারও অনেক ব্যবহার রয়েছে। যেমন ক্ষুদার্তকে খাওয়ানোর জন্য একটা ছুরি খাদ্য কাটার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। আবার এটা কাউকে হত্যা করার জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। এভাবে ফেইসবুক অধিক কল্যাণের কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে যেরুপ আমরা দেখি ফেইসবুক একজন Dictator বা একনায়ককে অপসারিত করতে প্রচন্ড সহযোগিতা করেছিল (Arab Spring এর সময়কার কথা)। ফেইসবুক কোন কিছু অর্গানাইজ করতে, কাউকে ডাকতে বা একত্রিত করতে একটি উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এমনকি ফেইসবুকে আমাদেরকে সৃষ্টিকর্তার সাথে এবং আমাদের একে অপরের সাথে সম্পর্ককেও শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত হতে পারে...অথবা ফেইসবুক আমাদের নাফসের অহংবোধ(অহংকার)কে বৃদ্ধি করতেও ব্যবহৃত হতে পারে।
ফেইসবুকটি এখন একটি আকর্ষণীয় প্রপঞ্চরুপে আবর্তিত হয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এখন অহংবোধ কাজ করছে। এখন আমাদের দায়িত্ব ফেইসবুকের কারণে যে অহংবোধ সৃষ্টি হয়েছে তা দমন করা(যাতে পূর্বশতর্কতামূল ব্যবস্থা নিতে পারি অন্ধকারপৃষ্টে যাওয়ার আগেই)।
অহংবোধকে প্রস্রয় দেওয়া মানে, যতই একে প্রস্রয় দেওয়া হবে ততই তা প্রবলতর হতে থাকবে। যখন এটা শক্তিশালী হয় তখন এটা আমাদেরকেই শাসন করে। অনতিবিলম্বে আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব থেকে বেরিয়ে যাই আর আমরা আমাদের নিজেদের দাসত্ব বরণ করি।( Soon we are no longer slaves to God; we become slaves to ourselves.)
অহংবোধ(Ego) এমন জিনিস যা ‘ক্ষমতা’ ভালোবাসে। এটা(ইগো)এমন জিনিস যা অন্যের ভালোবাসা দেখতে চায়, চায় স্বীকৃতি, প্রশংসা এবং উচ্ছসিত ধ্বনি। ফেইসবুক এগুলোর একটা প্ল্যাটফর্ম। এটা এমন প্ল্যাটফর্ম যা আমার সব শব্দ, ছবি, অথবা চিন্তা প্রদর্শন করতে, প্রশংসিত হতে এবং লাইক পেতে পারে। যার ফলে আমি এগুলো খুজতে থাকি। কিন্তু এটি আর শুধুমাত্র সাইবার ওয়ার্ল্ড এ সীমাবদ্ধ থাকে না। এমনকি আমি আমার মনের মাঝে বাস করি এই ‘দৃশ্যগ্রাহ্যতা’ময় বিশ্বকে ধারণ করে। হঠাৎ করে, আমার জীবনের সব অভিজ্ঞতা, ফটো, এবং প্রত্যেকটি চিন্তাই প্রদর্শিত হচ্ছে অন্যের কাছে – কারণ হল আমার মনের গহীনে চিন্তা কাজ করতে থাকে যে “আমি এগুলো ফেইসবুকে দেবো”। এটাই আমার অস্তিত্বের একটা আকর্ষণীয় বিষয় সৃষ্টি করে- যেন প্রত্যেকটা মুহুর্তই আমি বেঁচে আছি ‘ডিসপ্লে’তে(অন্যের নিকট প্রদর্শিত অবস্থায়)। আমার অনবরত চিন্তা হয়ে যায় প্রদর্শন, কারণ যা কিছু অন্যের জন্য ফেইসবুকে দেওয়া হয় সবই তারা দেখে এবং কমেন্ট করে।
সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- এটা আমাদের নিজস্ব তাৎপর্য বা গুরত্বের ভ্রান্ত ধা্রণা তৈরি করে যেখানে আমাদের প্রত্যেকটা চলাচলই গুরুত্ব বহন করে। অতিসত্ত্বর আমি ফোকাস হয়ে যাই-ডিসপ্লেতে। এখানে সংবাদটি হলঃ আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার জীবন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমার চলাফেরার প্রত্যেকটা পার্ট ই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ফল হয় “নিরন্তর প্রবলতর ‘আমি’ কেন্দ্রিক বিশ্ব”- যেখানে আমিই কেন্দ্রে আছি।
শেষে দেখা গেল এই ফল আমাদের অস্তিত্বের বাস্তবতার সাথে পুরোপুরি ভিন্ন। এই জীবনের উদ্দেশ্য হল সৃষ্টিকর্তার বিশালত্বের সত্য অনুধাবণ এবং আমার নগণ্যতা এবং তাঁর কাছে আমার চাওয়া। উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ ছিল আমাকে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে তার পরিবর্তে সৃষ্টিকর্তাকে(আল্লাহ) সেই কেন্দ্রে রাখা। কিন্তু ফেইসবুক ঠিক এর বিপরীত ‘মোহ’কে চিরন্তন করে তুলে।এটা এমন এক বিশ্বাসকে দৃঢ় করে তুলে যেন আমার নিজস্ব গুরুত্বের কারণ প্রত্যেকটি অবান্তর চলাচল বা চিন্তাও প্রদর্শিত হতে হবে। অপ্রত্যাশিতভাবে আমি যা খাই, বা শপ থেকে যা কিনি তাও খবর আকারে ফেইসবুকে প্রকাশ করি গুরুত্ব বিবেচনা করে। যখন আমি একটি ছবি প্রকাশ করি, আমি প্রশংসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি; আমি অপেক্ষা করি কৃতজ্ঞতা এবং উচ্চশিত প্রশংসার আকাংক্ষায়। ‘লাইক’ অথবা ‘কমেন্টস’ এর সংখ্যা দ্বারা এখন শারীরিক সৌন্দর্যকে নির্ধারণ করা হয়। যখন আমি একটি পোস্ট দেই, আমি অপেক্ষা করি ‘লাইক পাওয়ার জন্য’। আমি চিন্তা করতে থাকি এবং প্রতিযোগিতা করি কতজন ‘বন্ধু’ আমার আছে তা নিয়ে।(এসব ‘বন্ধু’ এমন বন্ধু যাদের ৮০% কে আমি ফেইসবুকের বাইরে চিনিই না।)
এই সার্বক্ষণিক ভাবনা এবং অধিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিযোগিতা আল-কোরআনে আল্লাহ উল্লেখ করেন –
“বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তোমাদেরকে(আখিরাত থেকে )উদাসীন করে দিয়েছে”- সূরা তাকাছুর-১
এই পাওয়ার প্রতিযোগিতা; হোক তা সম্পদ স্তুপ করার জন্য, ফেইসবুকে লাইক বা ফ্রিন্ডস পাওয়ার জন্য- ফলাফল একই; আমরা এর দ্বারা সার্বক্ষণিক চিন্তাবিষ্ট হয়ে গেছি।
ফেইসবুক আরো একটি বিপজ্জনক কেন্দ্রবিন্দুকে শক্তিশালী করেঃ অন্যের উপর ফোকাস, তারা কি করে, তারা কি লাইক করে। আমার সম্পর্কে তারা কি ভাবে । অন্যেরা আমার সম্পর্কে কি মূল্যায়ন করে-ফেইসবুক সেই মোহাবিষ্টতাকে প্রস্রয় দেয়। অচিরেই আমি ‘সৃষ্টি’র কক্ষপথে প্রবেশ করি। সেই কক্ষপথে আমার সীমানা, দুংখ, হাসি, আত্মতুষ্টি, আমার সফলতা এবং আমার ব্যর্থতা সবই নির্ধারিত হয় সৃষ্টির দ্বারা। যখন আমি সেই কক্ষপথে বাস করতে থাকি, আমি উর্ধে উঠি বা অধপতনে পতিত হই সৃষ্টির সাথে। যখন মানুষ আমার সাথে সুখে থাকে আমিও তাই থাকি। যখন তারা কষ্টে থাকে, আমি দুংখ পাই। আমি যেখানেই অবস্থান করি তা মানুষ নির্ধারণ করে। আমি একজন বন্ধীর মত কারণ, আমি আমার সুখ, দুংখ, পূর্ণতা এবং হতাশা সব কিছুর চাবি দিয়ে রেখেছি অন্য মানুষের হাতে।
স্রষ্টার কেন্দ্রবিন্দুর পরিবর্তে-একবারের জন্য আমি যখন সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করি এবং এখানে বসবাস করতে শুরু করি-তখন আমি এই ঘটনার সাথে ক্রমাগতভাবে চলতে থাকি। একটূ চিন্তা করে দেখুন- যেখানে সৃষ্টিকর্তার(আল্লাহর)কক্ষপথ হল তাঁর সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টি; তাঁর দেওয়া পুরষ্কার অথবা শাস্তি। কিন্তু সৃষ্টির অরবিট বা কক্ষপথ হল মানুষের প্রশংসা বা নিন্দা-সমালোচনা। সুতরাং আমি যতই এই সৃষ্টির পথে গভীর থেকে গভীরতরভাবে প্রবেশ করতে থাকি আমি এ ঘটনার ক্রমাগত চলমানতার গভীর প্রত্যাশী হই এবং এর হারানোকে আমি ভয় করি। যখন আমি বেশি একচ্ছত্রভাবে গেম খেলতে থাকি, তখন আমি এটা আরো বেশি বেশি চাই এবং এক্ষেত্রে ধনী হওয়া অনেক উচূ অনুভব করি। কিন্তু যখন গেম শেষ হয়ে যায়, আমি সেই গেমের প্রচূর অর্থ(অনলাইনে)দিয়ে বাস্তবে কী জিনিস কিনতে পারি?
প্রশংসা হল মানুষের গ্রহনযোগ্যতার একচ্ছত্র অর্থের মত। স্বল্প সময়ের সংগ্রহ অনেক বড় অনুভূত হয়। কিন্তু খেলা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন এটা মূল্যহীন। এই জীবনে এবং আখেরাতের বাস্তবতায় তা মূল্যহীন। কিন্তু তবুও আমরা এই ইবাদাতে এই মিথ্যা গ্রহনযোগ্যতা কামনা করি। এভাবে আমি ‘গোপনীয় শিরকে’র শিকার হই(রিয়া- ইবাদাতে অন্যকে দেখানো)। রিয়া হল সৃষ্টি হয় সৃষ্টির কক্ষপথে বসবাস করার ফলে। সৃষ্টির এই কক্ষপথে যতই আমি গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করতে থাকি, ততই আমি মানবিক প্রশংসা, সমর্থন, এবং স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নিঃশ্বেষিত হয়ে পড়ি। যতই আমি এই অরবিটে প্রবেশ করি ততই হারানোর ভয় করি- সম্মান, স্ট্যাটাস, প্রশংসা, এবং সমর্থন হারানোর ভয়।
যতই আমি মানুষকে ভয় করি(তাদের প্রশংসা, সমর্থন হারানোর ভয়), ততই আমি তাদের দাসত্ব বরণ করি। সত্যিকার স্বাধীনতা তো কেবল মাত্র তখনই আসে যখন আমি একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া সব জিনিস এবং মানুষের ভয়কে দূরে ঠেলে দেই।
একটি সুগভীর হাদীসে এসেছে- একব্যক্তি রাসূল সা এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে এমন কাজের নির্দেশ দিন যা করলে আমাকে আল্লাহ এবং মানুষ ভালোবাসবে। রাসূল সা বললেন-“পার্থিব দুনিয়া থেকে বিচ্চিন্ন হয়ে যাও, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবে। মানুষের সাথে যা আছে তা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নাও, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে” – ইবনে মাজাহ।
দূর্ভাগ্যজনকভাবে, যত কম আমরা মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসার পেছনে যাই, তত বেশি এগুলো অর্জন করতে থাকি। যত কম আমরা অন্যের প্রয়োজন চাই, তত বেশি তারা বেশি আমাদের আকর্ষণ করে এবং আমাদের সঙ্গী হিসেবে চায়। এই হাদীস আমাদেরকে একটি গভীর সত্যকে তুলে ধরে। কেবলমাত্র সৃষ্টির অরবিট থেকে নিজেকে মুক্ত করার মাধ্যমেই আমরা সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টি উভয়ের সাথেই সফল হতে পারি।
সুতরাং যেখানে ফেইসবুক একটি প্রকৃতই শক্তিশালী হাতিয়ার, তাহলে এটাকে তোমার স্বাধীনতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করো- তোমার নিজের এবং অন্যের মূল্যায়নের দাসত্ববরণের হাতিয়ার হিসেবে নয়।
-----------------------------------------------------------------
উস্তাযা ইয়াসমিন মোজাহেদ এর অসাধারণ বই “Reclaim Your Heart” থেকে অনুদিত, কিঞ্চিত এডিট করে।
জীবনের অতল সমুদ্রের গর্ভে পতিতি হওয়া মানুষদের আল্লাহর পথ দেখানো অনেক কঠিন একটি কাজ। কিন্তু যারা এ পথ পাড়ি দিয়েছেন তাদের জীবনের বাস্তবিক চিন্তা-দর্শন যখন জীবনের বাস্তবিকতায় ফুটে উঠে তখন সেই গভীর সমুদ্রে পড়ে যাওয়া মানুষদের আলোর দিশারী হিসেবে কাজ করে...জীবনকে আবার ফিরে পায় আগের থেকে অনেক উৎকৃষ্টরুপে...যেন পতিত হওয়া থেকে শুধুমাত্র উঠে আসা নয় বরং আরো উন্নততররুপে রবের নিকটে ফিরে যাওয়ার এক উজ্জ্বল প্রদ্বীপশিখা প্রসারিত করেছে আলোকছটায়।
স্ট্রেজ, কষ্ট, পাপের গহীনে ঢুবে যাওয়া, পথ হারা পথিক, আলোকায়নের যাত্রী, এটাচমেন্ট, ভালোবাসা, আধ্যাত্বিকতা, রবের কাছে ফিরে যাওয়া, তাওহীদের গভীর অনুভূতি, আল্লাহর হিকমাহর অন্তদৃষ্টি, মুসলিম উম্মাহ ইত্যাদি বিষয়ে এত গভীর অনুভূতি ও কোরআন-সুন্নাহর আলোচনা স্থান পেয়েছে যা একজন ব্যক্তির আলোকায়নের পথে পূনরায় ফিরিয়ে আনতে প্রদীপ্ত আলোকদ্বীপ্তির মত কাজ করবে ইন শাআ আল্লাহ।
উস্তাযার সাইট - http://www.yasminmogahed.com/
বইটি কিনতে ১৭/১৮ ডলার লাগে, আমি এখানে ফ্রি দিয়ে দিলাম। বিনিময়ে আপনাদের দোয়া প্রত্যাশী।