Monday, July 13, 2015

তাদাব্বুরে কুর’আনঃ কুর’আনের স্বাদ, গভীরতা, মু’জিযা ও প্রজ্ঞার আরেক খনি – ১ম পর্ব

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আলহামদুলিল্লাহ, সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক রাহমাতাল্লিল আলামীন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর, তাঁর পরিবার, বংশধর ও সমস্ত সাহাবা ও সালফে সালেহীনদের উপর।

“তারা কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না, আর যদি এটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট থেকে আসত তবে এতে অনেক ইখতিলাফ -দ্বন্ধ পেতো”।

অথচ আমরা অনেক ইখতিলাফ পাই মুসলিমদের মাঝেই। তবে এই আয়াতের দিকে তাকালেই এই মতবেধ ও ঝগড়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়—গবেষণা না করা। 

অত্র আর্টিকেলটি কুরআনের তাফসীরের এক গবেষণার ফল—যা অভিন্ন রীতিকে অভিন্ন কুরআনের গবেষণায় নিয়োজিত রেখেছে। তাই অভিন্ন রীতির মাধ্যমে গবেষণার মাধ্যমে এর হিকমাহকে খুঁজে পেতে, কুরআনের ভেতরকার অভিন্ন মূলনীতির মাধ্যমে গবেষণামূলক পদ্ধতিতে তাফসীর করা হয়েছে—তাই ইখতিলাফের চূড়ান্ত অপনোদন করে এর বিপরীতে আল্লাহর প্রজ্ঞার গভীরতার প্রকাশ পেয়েছে। এটাই গবেষণার ফল যা আল্লাহ করতে বলেছেন।

ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ

“যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়ল না, সে কুরআন শরীফকে বর্জন করল।আর যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়ল অথচ তা নিয়ে তাদাব্বুর করল না সেও কুরআনকে বর্জন করল।আর যে ব্যক্তি তাদাব্বুর করলো অথচ এর উপর আমল করল না সেও কুরআনকে বর্জন করল”।

মানব-জাতির সকল সমস্যার সমাধান যে গ্রন্থ, তা কখনই বিশৃংখল নয়, বরং এর বিপরীতে এর মহা-শৃংখলার মাঝেই রয়েছে গভীরতা এবং রাহমা ও প্রজ্ঞার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।

হাদীসের ক্ষেত্রে যুগে যুগে আধুনিকায়ন ও উন্নতি সম্মিলিত বা বই আকারে না আসলেও কুরআনের ক্ষেত্রে আমরা এর চমৎকারিত্ব দেখতে পাই এর ব্যাখ্যার ক্রম আধুনিকায়নের মাঝে। তাফসীর ইবনু আব্বাস থেকে শুরু করে প্রাচীন বহু তাফসীরের পদচারণা ইবনু কাসির, ইবনু জারির, তাফসীর কাশশাফ, রুহুল মায়ানি এবং এভাবে চলেছে। আধুনিক দিকে চলেছে ইবনে আশুর, ফি যিলালিল কুরআন, মাওলানা মওদূদীর তাফসীর ইত্যাদি। এভাবে কুরআনের বিচিন্ন দিক থেকে তাফসীর চলেছে—সাহাবার তাফসীর, ভাষা-ব্যাকরণগত তাফসীর, বালাগাহ, ভাষার সৌন্দর্য ও গভীরতামূলক তাফসীর, যুক্তিভিত্তিক তাফসীর, ফিকহী তাফসীর, কুরআন দ্বারা কুরআনের তাফসীর, কুরআন-হাদীস দ্বারা তাফসীর, কুরআন-হাদীস-আছার-সালফে-সালেহীনদের ভিত্তিতে তাফসীর, আধুনিকতার ভিত্তিতে তাফসীর…এভাবে কুরআনের অসীম প্রজ্ঞার দ্বার ক্রমাগত বের হচ্ছেই এবং হবেই। এটাই আল্লাহর কালামের বৈশিষ্ট- এর অবারিত রাহমা ও প্রজ্ঞা- কোনোটারই শেষ নেই।

এভাবে এই কালামুল্লাহর আরেক নতুন সংযোজন—তাফসীর তাদাব্বুরে কুরআন। এই কুরআনের ব্যাখ্যা কুরআনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা রত্নের ভিত্তিতেই করা—এখানেই এর তাফসীরের গভীরতার নমুনা। যার পদচারণা এর ভেতরের রত্নভান্ডার, সৌন্দর্য, মুজিযা ও প্রজ্ঞার মধ্য দিয়েই চলেছে গবেষণায় হাতড়িয়ে।
এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে কুরআন যেন একটি নির্দিষ্ট প্রজ্ঞাময় ছকে চলে এসেছে অথচ এ ছক বা চার্ট কোনো পার্থিব কারো তৈরি করা নয়। এজন্য ছক যেরুপ সহজীকরণের জন্য করা এর মাঝেও সেই রকম সহজ Structure, Order, Descipline রয়েছে অথচ এই সহজের ভেতরের রয়েছে গভীর প্রজ্ঞা, অসীম জ্ঞানের ধারা, রাহমাতের প্রবাহ এবং এটি মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধানের নির্ভুল অথচ প্রচন্ড শক্তিশালী কিন্তু প্রজ্ঞার সাথে যা সবকিছুকে তুলে ধরে—যেই প্রজ্ঞার জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া ছিল নবী-রাসূলদের একটি উদ্দেশ্য। এটি কেবল কিছু তথ্য নয়, কিছু জ্ঞান নয় বরং এর বাহিরের আরো গভীরতম কিছু—যাকে বাস্তবিক, দূরদর্শী, প্রজ্ঞাময় উপকারিতার আলোকে দেখা হয়। এটিই প্রজ্ঞা, এটি সার্বিক উপকারিতা। এটিই ওহীর বৈশিষ্ট।

এই তাদাব্বুরে কুরআনের মাঝে রয়েছে অনেকগুলো পদ্ধতি—সবগুলো পদ্ধতির আলোকেই কুরআনের ভেতরের রত্ন-ভান্ডারকে খুঁজে পেতে হবে। যার মাঝে প্রজ্ঞা থাকে তাঁর মাঝে বিশৃংখলা নয় বরঙ শৃংখলার শক্তিশালী ধরণই থাকে প্রজ্ঞার চরম প্রকাশ- এবং এটি যদি হয় দীর্ঘ জীবনের প্রয়োজনের ভিত্তিতে তৈরি করা এমন কিছু মূলনীতির আলোকে যা চলবে অনন্তকালের দুনিয়ার জীবনের পথপ্রদর্শকস্বরুপ—সেটিতো প্রজ্ঞার চূড়ান্ত নিদর্শনই হওয়ার কথা। এটিই সেই কুরআন যা বিশৃংখল তো নয়ই—বরঙ এর চূড়ান্ত শৃংখলা, আয়াত ও বিষয়বস্তুর বিন্যাসধারা, সূরা ও গ্রুপ ভিত্তিক বিন্যাসধারার চলমান শৃংখলা—এভাবে পূর্ণ কুরআনের শৃংখলার মাঝেই—এবং যেই শৃংখলা রয়েছে অনেকগুলো ডাইমেনশনের আলোকে—সেই শৃংখলার মাঝেই যেন এই কুরআনের প্রজ্ঞার সীমাহীন সৌন্দর্য, প্রজ্ঞা, এবং জীবনের চূড়ান্ত সমাধান লুকিয়ে আছে। তাদাব্বুরের কুরআনের উদ্দেশ্য সেটাই। কুরআনের গভীরে প্রবেশ করে এর ভেতর থেকে আনতে হয়েছে এর সৌন্দর্য, প্রজ্ঞা, রাহমা এবং জীবনের চূড়ান্ত অথচ বাস্তবিক ও চাতুর্মুখিক সমাধান—যা উপকারের নহরের প্রবাহ চলেছে চলমান।

মাওলানা হামিদ্দুদ্দীন ফারাহীর (রাহিমাহুল্লাহ) উত্তরসূরী মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী (রাহিমাহুল্লাহ) এর মাধ্যমে কুরআনের শর্তমত কুরআনের ভেতরেরি লুকিয়ে থাকা এবং গভীরতর তাফসীরের নিমগ্নে নিয়োজিত ছিলেন জীবনের পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়েরও বেশি—কেবল কুরআনের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এর গভীরতা, সৌন্দর্য, প্রজ্ঞা ও রাহমাহর খনিতে—এটিই তাফসীর তাদাব্বুরে কুরআন।



আমি পিডিএফ(PDF)-টি ডাউনলোড করে পড়তে বলব। কারণ ব্লগে কিছু জটিলতা থাকায় অনেক সেটিং নষ্ট হয়ে যায়। এদিক থেকে পিডিএফ-টি অনেক গুছানো, সাজানো এবং দৃষ্টি নন্দন করে দেওয়া আছে।
 


যেকোনো সাজেশন এখানে – alsabanow13@gmail.com


কুরআন উপলব্ধির জন্য আল্লাহর শর্ত

এখানে চিন্তার সাথে সম্পৃক্ত কয়েকটি শর্ত বর্ণনা করা হলো…আল্লাহর কাছে হেদায়েত চাওয়া, দোয়া করা বা এসব চিন্তার বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আমল করা- এগুলো বর্ণনা করা হলো না।

কুরআন উপলব্ধির জন্য আল্লাহ কিছু শর্ত দিয়েছেন। যেগুলো না হলে কুরআনের উপলব্ধি সম্ভব নয়। ল্যাপটপ তৈরিকারক সর্বাপেক্ষা ভালো জানে এতে কি ম্যাকানিজ আছে, এতে কি দরকার সঠিক পরিচালনার জন্য বা কীভাবে ব্যবহার করলে এটি ভালো থাকবে ও সর্বাপেক্ষা উপকার নেওয়া যাবে। তেমনি আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা, তিনি আমাদের সকল মেকানিজম খুবই ভালো করে জানে। আর তাই তাঁর সম্মানিত কিতাব থেকে কীভাবে উপকার নিতে হবে সেগুলোও তিনি বলে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর রহমতে বাকীটুকু আমাদের ইচ্ছার উপর—চিন্তা-ভাবনার উপর।

“এর মাঝে সে ব্যক্তির জন্য স্মরনিকা (উপদেশ) বাণী রয়েছে, যার মাঝে সজাগ হৃদয় রয়েছে অথবা একাগ্রচিত্তে যে শ্রবণ করে”। (সূরা কাফফ – ৩৭)

— কুরআনে রয়েছে স্মরণ। আপনি একটা বিষয় ভালোভাবে হৃদয় দিয়ে, মনোযোগ দিয়ে না শুনলে সেটাকে স্মরণে রাখতে পারবেন না। তাই কোনো কিছু স্মরণ রাখার জন্য এবং এ স্মরণ থেকে উপদেশের মাধ্যমে ভালো কিছু পাওয়ার জন্য চিন্তা-ভাবনা দরকার—যার জন্য হয়তো আপনাকে বিশুদ্ধ হৃদয় দিয়ে একে মনে রাখার জন্য জানতে হবে অথবা একাগ্রচিত্তেই মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে (স্মরণের সাথে মনোযোগ ও চিন্তার সম্পর্ক)।

আর এ সজাগ হৃদয় সম্পর্কে সূরা সাফফাত এ বলা হচ্ছে – “কিন্তু যে লোক আল্লাহর কাছে সুস্থ বিবেক নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেছে”।

সূরা কাফফ এ বলেছেন – “যে লোক আগ্রহান্বিত হৃদয় নিয়ে এসেছে”।

রাসুল (সা) তো নফল ইবাদাতকারীদের আসরে না বসে যারা কুরআন নিয়ে চিন্তা-ফিকির করতেছিল তাদের আসরে বসে চিন্তার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিলেন। কারণ চিন্তার সাথে হেদায়েতের সম্পর্ক রয়েছে সরাসরি। একারণে দেখবেন কুরআনে যত জায়গায় আকল শব্দটাকে ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে মূলত খৃষ্টানদের পথভ্রষ্টতার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারা চিন্তা-ভাবনা করতো না এবং এভাবে নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়ে যায়(সূরা ফাতিহা)।

“আর আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি স্মরণের জন্য। আছে কি কেউ স্মরণকারী?” (সূরা কামার – ২২)

—অমনোযোগিতার সাথে স্মরণ বা মুখস্ত রাখা এবং আমল করার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ যে মনোযোগী নয়, সে স্মরণ রাখবে কীভাবে? তাহলে তার এ থেকে উপদেশ নিয়ে উপকৃত হওয়া তো অসম্ভব। সুতরাং কুরআনের হেদায়েত বা এর থেকে কিছু নেওয়ার জন্য শর্ত হলো এটাকে জিকর বা স্মরণের মাধ্যমে, চিন্তার মাধ্যমে উপদেশ নেওয়া।

সূরা ইয়াসিনে কুরআনকে প্রজ্ঞাময় বলা হয়েছে। আচ্ছা প্রজ্ঞা বলতে কি বুঝায়?

জ্ঞানের ৩টি ধারা এরকম –

১। প্রথমে থাকবে তথ্য—যা কুরআনে বা ইন্টারনেটে প্রচূর আছে। মুসলিম-অমুসলিম সবার কাছেই আছে। শতকোটি তথ্য থাকলেও কারো কোন লাভ নেই।

২। এরপর আসে জ্ঞান – জ্ঞান হলো তথ্যকে যখন পদ্ধতিগত উন্নতিতে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। ইন্টারনেটে বা কুরআন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাজার হাজার তথ্য কিন্তু একে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে জ্ঞানে আনা হয়—যেমন সবগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘটনাগুলো থেকে কী কী শিক্ষা আসে, হুদুদের সবগুলো আয়াতকে একত্রিত করে একে কীভাব প্রয়োগ করবো সেগুলো জানা। একটা সফটওয়্যার দিয়ে কীভাবে সিস্টেম্যাটিক্যালি কাজ করতে হবে তাঁর জন্য তথ্যকে সাজিয়ে জ্ঞানে পরিণত করা।

৩। প্রজ্ঞা– এটাই হলো সর্বশেষ এবং প্র্যাক্টিকাল ও ব্যাপক উপকারের স্তর। কুরআনে আল্লাহ নবীদের পাঠানোর একটা উদ্দেশ্যই হলো ‘হিকমাহ’ শিক্ষা দেওয়া (সূরা বাকারাহ-১২৯)। এই হিকমাহ বা প্রজ্ঞা হলো—জ্ঞানকে সঠিকভাবে বুঝে, সঠিক মাত্রায়, সঠিক স্থানে, সঠিক ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করা এবং এর বাস্তবিক উপকার পাওয়া। অর্থাৎ সুগভীর ও বিসৃত জ্ঞানের স্তর। আমাদের যাদের জ্ঞান আছে তারা হয়তো কোন জিনিসের একটা বা দুইটা দিক দেখি, যার মাঝে আবার দূরদৃষ্টি নেই। কিন্তু যাদের প্রজ্ঞা রয়েছে তারা চাতুর্মূখিক দৃষ্টির মাধ্যমে দেখতে পারে, তাদের রয়েছে দূরদর্শিতা- বিস্তৃত ও গভীর জ্ঞানের কারণে।

উমর (রা) চুরের হাত কাটেনি। কারণ? চুরের হাত কাটার জন্যই ইসলামী আইন প্রাথমিকভাবে নয়। বরং আল্লাহর দয়া, পৃথিবীতে প্রশান্তি এগুলোই প্রথম (রাব্বুল আলামীন এবং রাহমাতাল্লিল আলামীন)। তাই কেউ যেন চুরির পরিস্থিতিতেই না পড়ে ইসলাম সেই ব্যবস্থা আগে করে—অর্থাৎ কখনো যেন আইন প্রয়োগ-ই না করতে হয়।

সুতরাং কুরআন কী? হিকমাহ-প্রজ্ঞা। তবে প্রকৃতই বুঝতে পারছেন কুরআন হলো জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরের উপলব্ধি যার জন্য রাসূল (সা) কে পাঠানো হয়েছে এবং এর ব্যবহারিক দিকের দয়া, রাহমাহ ও সৌন্দর্য আমরা রাসূল সা এর যুগ থেকে সোনালি যুগের ইতিহাসে দেখতে পাই। সুবহানাল্লাহ!! আল্লাহর এতো এতো দয়া(সূরা আর রাহমান-১-২) যে তিনি একে প্রজ্ঞাময় কুরআন(সূরা ইয়াসিন-২) করে দিয়ে আমাদের চিন্তার, গবেষণার(সূরা মুহাম্মাদ) এবং এর থেকে সর্বোচ্চ উপকারের বাণী নাযিল করেছেন।
আর এ কুরআনের সর্বোচ্চ হিকমাহর উপকারিতা পাওয়ার জন্য আল্লাহ পথও দেখিয়ে দিয়েছে…চিন্তার লেভেলের বিভিন্ন মাধ্যমে। সেগুলো

১। তাজাক্কুর—চিন্তা-ভাবনা করা।
২। আকল খাটানো- সহজাত(ফিতরাত) সত্য-মিথ্যার পার্থক্য উপলব্ধি।
২। ফিকর করা – চিন্তাকে আরো গভীরে নিয়ে যাওয়া।
৪। তাদাব্বুর করা – সর্বোচ্চ লেভেলের চিন্তা-গবেষণা করা—যা প্রজ্ঞার কাছে নিয়ে যাবে।

এভাবে সমস্ত কুরআন জুড়েই শত শত আয়াতের শেষেই পাবেন আল্লাহ বিভিন্ন চিন্তাসূচক শব্দের মাধ্যমে আমাদের চিন্তার ধারাকে শানিত করে উপলব্ধির জন্য আহবান জানাচ্ছে।

লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন তা’কিলুন, তাযাক্কারুন, তাফাক্কারুন শব্দগুলো… প্রায় প্রত্যেক বড় বড় সূরাতেই আছে।

“তারা কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?”। সূরা মুহাম্মাদ- ৩৩

আয়াতটিকে লক্ষ্য করেছেন? আপনার অন্তর তালাবদ্ধ থাকা মানে গবেষণা না করার সাথে সম্পৃক্ত। নির্দিষ্ট তালার জন্য ঠিক সেই নির্দিষ্ট চাবিই লাগবে। সে হিসেবে সকল পাপ থেকে বিরত থাকতে হবে, নিরপেক্ষভাবে আল্লাহর কালামকে গভীরভাবে চাতুর্মুখিকভাবে ভাবতে হবে, গবেষণা করতে হবে—তবেই কুরআন নিজের সম্মুখে প্রকাশিত হবে এর প্রজ্ঞা নিয়ে।

সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং এবং গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আয়াত লক্ষ্য করুন যা সূরা নাহলে(১১,১২,১৩) বর্ণিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে।

১১ নং আয়াতের বিষয়-পানি। এটির জন্য ফিকির শব্দ এসেছে। এতে অনেক বেশিই চিন্তা করতে হয় বলে। পানির উপর আমাদের জীবন নির্ভর করে…অনেকভাবেই(সকল প্রকার শস্য উৎপাদন, খাবার পানি, আমাদের শরীরে পানি, পৃথিবীর সমস্ত ময়লা পানি দ্বারা দৌত না করলে কি হতো?,…আরো অনেক বিষয় রয়েছে)। এতে চিন্তা অনেক বেশি তাই ফিকির শব্দ ব্যবহার করেছেন আল্লাহ উপলব্ধির শর্ত হিসেবে।

১২ নং আয়াতের বিষয়- চন্দ্র ও সূর্য। চন্দ্রের মাধ্যমে পথের দিশা আর সূর্যের শক্তি না পেলে পৃথিবীর কোন কিছুই উৎপন্ন হতো না আর আমাদের জীবন রক্ষা তো দূরের কথা। এটার জন্য তেমন বেশি চিন্তা করতে হয় না—ফিতরাত ই যথেষ্ট। যার জন্য কেবল আকলই যথেষ্ট। আল্লাহ সেটাই ব্যবহার করেছেন।

১৩ নং আয়াতে বিভিন্ন রঙ এর কথা এসেছে। এতেও নিদর্শন রয়েছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ গাছ সবুজ না হয়ে কালো হলে সবাই অন্ধ হয়ে যেতো!। অবশ্যই এর বিভিন্ন রঙ এর মাঝে নিদর্শন রয়েছে। এগুলোর জন্য স্মরণ শক্তির চিন্তা দরকার। আল্লাহ জাক্কারা শব্দ ব্যবহার করেছেন।

এভাবে আল্লাহ বিভিন্ন লেভেলের চিন্তাকে কতভাবেই না উৎসাহিত করেছেন তাঁর সকল প্রকার আয়াত(আয়াত, নিদর্শন, হিকমাহ, দয়া) ইত্যাদি উপলব্ধির জন্য। চিন্তাগুলো এত এতই গুরুত্বপূর্ণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে যে এই চিন্তার মাধ্যমেই আল্লাহর হিকমাহ-আয়াতকে উপলব্ধির জন্য আহবান করছেন প্রতিনিয়ত।

আর এই তাফসীরের ধারা- তাফসীর তাদাব্বুরে কুরআন—এটি চিন্তার সর্বোচ্চ ধারাকে সামনে রেখেই করা হয়েছে—তাদাব্বুর।

আল্লাহ বলেনঃ

“যারা আমার পথে চেষ্টা করে আমি তাদের অনেক পথ দেখাবো”।
আনকাবুত – ৬৯

আল্লাহর কাছে সবই আছে, আমাদের চিন্তা যেন সেই দিকের বোঝ দান করেন আল্লাহর রহমতে।
মুফাসসিররা তাদের হেদায়েতের জন্য চিন্তা করেছে তাদের হৃদয় দিয়ে আর আমরা সেগুলো পড়েই থেমে থাকবো না। আমাদের নিজস্ব হৃদয়কে আল্লাহর কালামকে উপলব্ধির জন্য ব্যবহার করতে হবে। তাদের হৃদয়ের চিন্তায় তারা আল্লাহর হেদায়েত পেয়েছে আর আমাদের চিন্তা-গবেষণা দিয়ে আমাদের আল্লাহর বাণী উপলব্ধির মাধ্যমে আল্লাহর প্রজ্ঞা বুঝতে হবে, উপলব্ধির গভীর মাত্রায় যেতে হবে, নিতে হবে আল্লাহর সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি— তাঁর কুরআনের প্রজ্ঞাময় নিদর্শন উপলব্ধির মাধ্যমে আমল করে।
ওমর (রা) এর সূরা বাকারাহ শেষ করতে ৩ বছর লাগার কারণ কী?…চিন্তা, ফিকির, গভীরতর চিন্তা ও গবেষণা এবং প্রাজ্ঞতার উপলব্ধির মাধ্যমে আমল। তারা কুরআন বুঝতে এসেছিলেন আল্লাহর শর্তকে সামনে নিয়ে। এজন্য সেই যুগ সোনালি যুগ, ছিল সর্বোচ্চ শান্তি ও উন্নতির যুগ।

এই তাফসীর অর্থাৎ তাদাব্বুরে কুরআনের চিন্তাগুলো সর্বোচ্চ লেভেলের চিন্তা থেকেই তিনি করেছেন—অর্থাৎ তিনি তাদাব্বুর করেছেন। আল্লাহর হিকমাহ বা প্রজ্ঞার দেখা সম্ভব এই তাদাব্বুরের মাধ্যমেই। তাঁর তাদাব্বুরের চিন্তাকে সাথে নিয়ে আমরা এই চিন্তার সাথে শামিল হয়ে আল্লাহর প্রজ্ঞাময় কুরআনকে উপলব্ধির জন্য তৈরি তো?
“হে নবী! এটি এক বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি এই জন্য নাযিল করেছি যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহে চিন্তা-ভাবনা করে এবং বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে।” – (সূরা সোয়াদ-২৯)
কিতাবের বারাকাহ, আল্লাহর বারাকাহ তাদাব্বুরের সাথে সম্পর্যুক্ত। অর্থাৎ তাদাব্বুর ব্যতীত এই প্রজ্ঞাময় কুরআনের (সূরা ইয়াসিন) কুরআনের বারাকাহ (স্বল্প কাজে অচিন্তনীয়-অসীম নেয়ামত পাওয়া) সম্ভব নয়। কিন্তু এই তাদাব্বুর করবে কারা?… উলুল-আলবাব…যারা উপদেশ গ্রহণ করে।

“বলুনঃ আমার প্রতিপালকের কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য সমুদ্র যদি কালিও হয়,আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হবার আগেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে। যদিও এর মত অনুরূপ আরো একটি আনা হয়” – সূরা কাহাফ-১০৯

ছোট্ট একটা কলম—কত পেইজ লেখেন?…একটা সমুদ্র দিয়ে কতগুলো কলম হবে?…কলমই তো চিন্তা করতে পারতেছেন না আবার এগুলোর মাধ্যমে লেখার চিন্তা করতে পারেন?…এই চিন্তাটুকুই করতে পারতেছেন না আবার যদি অনুরুপ সমুদ্রও যোগ হয়?!!

এই প্রজ্ঞা, অসীম গভীরতর জ্ঞানের ধারা বহমান এই কুরআনের প্রতিটি পাতায় পাতায়। দেখতে চান?…আল্লাহর শর্তগুলোকে সামনে নিয়ে চলতে থাকুন কুরআনের পথে…। ইমাম ফখরুদ্দিন আল-রাযী (রাহিমাহুল্লাহ) যদি সূরা ফাতিহার তাফসীর ১ হাজার পৃষ্টা লিখতে পারেন…তবে কুরআনের প্রজ্ঞা, আল্লাহর প্রজ্ঞাময় বাণীকে উপলব্ধি করতে তাঁর শর্ত মোতাবেক চলুন…দেখুন কি প্রজ্ঞা, অসীম চিন্তার মাঝে কত প্রশান্তি, বারাকাহ, কত গভীরতা…যার মাঝে প্রবেশে কেবল শান্তি আর শান্তি।
আল্লাহর বাণী থেকে বারাকাহপূর্ণ উপকারিতা নেওয়ার শর্ত তাদাব্বুর করা।

উপলব্ধির একটি সিস্টেম্যাটিক মাধ্যম

আমরা সাধারণত যেকোনো বই পড়ি চ্যাপ্টার বা অধ্যায় আকারে এবং এগুলোর ভেতরে অনেক পরিচ্ছেদ থাকে। যার কারণে বইটি একটি ধারাবাহিক বিন্যাস এবং বিন্যাসের কারনে থাকে ধারাবাহিক সম্পর্ক এবং এভাবে থাকে যাতে পূর্ণ উপলব্ধির ক্ষেত্রে কোন গ্যাপ না থাকে। এভাবে পড়তে গেলে কোনো কিছু উপলব্ধির ক্ষেত্রে কোন জটিলতা থাকে না। কারণ পূর্বে যা কিছু বলা হয়েছে তার সাথে সম্পর্ক এবং ধারাবাহিকতা দুটোই চলেছে সমানভাবে প্রত্যেক অধ্যায় ও অনুচ্ছেদের অগ্রগতির সাথে। এ যেন একেকটা পূর্ব অধ্যায় পরের অধ্যায়কে উপলব্ধির চাবিস্বরুপ এবং প্রত্যেকটি অধ্যায়ের ভেতরের পূর্ব অনুচ্ছেদ তার পরের অনুচ্ছেদের উপলব্ধির চাবিস্বরুপ। এভাবে পড়লে কোন কিছু উপলব্ধির ক্ষেত্রে কি বাধা থাকতে পারে? না। কারণ আমার যা সমস্যা থাকতে পারে উপলব্ধির ক্ষেত্রে তা তো পূর্বের অধ্যায় এবং অনুচ্ছেদগুলোতে সেগুলোর ধারাবাহিক বর্ণনা ও পারস্পারিক সম্পর্ক একে পরিষ্কার করেই দিচ্ছে, প্রত্যেকবারই। এভাবে পদ্ধতি বা মেথড অনুসরণ করলেই না বইটি পড়া শেষে একটা ভালো ফল আসবে ব্যবহারের সময়। আর সিস্টেম্যাটিক পড়া না হলে এর ফলও কিন্তু বিচ্ছিন্ন বা ভুল আসতে বাধ্য…কারণ উপলব্ধি বা সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে যেই ফল আসার কথা তা আসবে না ভুল পদ্ধতিতে ভুল উপলব্ধির কারণে।

তাহলে কুরআনের মাঝে যদি এরকম প্রত্যকে সূরা এবং আয়াতগুলোর মাঝে ধারাবাহিক যোগসূত্র ও সেগুলোর মাঝে পারস্পারিক সম্পর্ক থাকতো বিষয়বস্তুর আলোকে, তবে কুরআন উপলব্ধির অনেক বড় একটি জটিলতা দূর হয়ে যেতো না?। কিন্তু আমরা কি জানি এই কুরআনের মাঝেও রয়েছে এরকম বিষয়বস্তুগত আলোচনা, পারস্পারিক সম্পর্কগত ধারাবাহিকতা—ঠিক যেমনটি বই এর প্রতিটি অধ্যায় আরেকটি অধ্যায়কে উপলব্ধির ক্ষেত্রে পরিষ্কার করে দিচ্ছে সব, প্রতিটি পরিচ্ছেদ পরের পরিচ্ছেদকে উপলব্ধির ক্ষেত্রে সব কিছুকেই পরিষ্কার করে দিচ্ছে। বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা এবং এদের মাঝে পারস্পারিক সম্পর্ক-এর মাঝে সকল ধরণের জটিলতাকে একদম পষ্ট আকারে তুলে ধরে উপলব্ধির দুয়ারকে একেবারে খোলাসা করে দিচ্ছে। যার কারণে কুরআনের সঠিক উপলব্ধির কারণে সঠিক ব্যবহারিক প্রয়োগও সম্ভব এবং এর বিপরীতে ভুল পদ্ধতিতে উপলব্ধি বা বিচ্ছিন্ন উপলব্ধি কিন্তু ভালো ফল দেবে না কখনই।

এভাবে কুরআনের প্রতিটি আয়াত তার পূর্বের ও পরের আয়াতের সাথে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। প্রতিটি সূরা তার আগের ও পরের সূরা সাথে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। প্রতিটি সূরার একেকটি বিষয়বস্তু রয়েছে, সেগুলোর মাঝেও সূরার যাবতীয় আয়াতের সাথে এসব সম্পর্ক ও ধারাবাহিকতা বিদ্যমান।

তদ্রুপ ১১৪ টি সূরা যেন বিষয়বস্তুর আলোকে বিভিন্ন বড় বড় গ্রুপে বিভক্ত এবং এসব বিভক্তির মাঝেও বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা ও পারস্পারিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রেখেই চলেছে সম্পূর্ণ কুরআন জুড়ে।

এ থেকে স্পষ্টত বুঝা যায় যে, সম্পূর্ণ কুরআন একটি সুশৃংখল, ধারাবাহিক ও পারস্পারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সবকিছু পরিষ্কার রেখেই সাজানো হয়েছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ওহীভিত্তিক নির্দেশে। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেভাবে তাঁর কুরআনকে সাজিয়েছেন আয়াত, সূরা এবং বিষয়বস্তর ধারাবাহিক বিন্যাস ও পারস্পারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে-ঠিক সেভাবে উপলব্ধিই আমাদেরকে তাঁর হিকমাহর গভীরতা বুঝতে ও ইসলামের সঠিক অনুধাবনে সাহায্য করবে। আর ঠিক এ সাজানো পদ্ধতি ব্যতীত বিশৃংখল পদ্ধতিতে গেলেও আমাদের উপলব্ধিতেও বিচ্ছিন্নতা বা বিশৃংখল উপলব্ধ আসবে-সঠিক উপলব্ধি না আসার সম্ভাবনাই প্রবল।

যেকোনো লেখক জানে বইয়ের ধারাবাহিক বিন্যাস করা হয় উপলব্ধির জন্য, এবং উপলব্ধি না আসলে বই লেখার কোন মানেই হয় না। ‘উপলব্ধি’ই থাকে মৌলিক উদ্দেশ্য(কারণ সঠিকভাবে উপলব্ধির অভাব তা প্রয়োগে ভুল হয় এবং এভাবে মূল উদ্দেশ্যও ব্যহত হয় বা অনেক ক্ষেত্রে তা বিপরীত মন্দাবস্থা তৈরি করে।) তেমনি বইটি এলোমেলোভাবে পড়লে কোন কিছু স্পষ্ট ও সিস্টেম্যাটিক জ্ঞান তো হবেই না, অনেক ক্ষেত্রে লেখক যা বুঝাতে চেয়েছে প্রসঙ্গ, ধারাবাহিকতা এবং পারস্পারিক সম্পর্কহীনভাবে নিলে উল্টো অর্থও হতে পারে বা বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়ার কারণে নিজেও যেকোনো অর্থ ঢুকিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিকৃতির সমূহ সম্ভবনা রয়েছে।

পবিত্র কুরআনের ক্ষেত্রেও আমরা এটি দেখতে পাই। প্রত্যেকে দলই বিচ্ছিন্নভাবে কুরআনের আয়াত, সূরাকে ব্যবহার করার কারণে এ থেকে নিজেদের সুবিধামত অর্থ নিয়ে নিজেরাই বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে। অথচ অভিন্ন রীতি যা আল্লাহ এই কুরআনের মাঝেই রেখে দিয়েছে উপলব্ধির জন্য, তা দিয়ে উপলব্ধির করলে কেউ নিজেদের মত করে কোন অর্থ বের করতে পারবে না। কারণ তাকে যেকোনো অর্থ বললেই তার পূর্বের ও পরের বিষয়বস্তু ও পারস্পারিক ধারাবাহিকতা বুঝিয়ে দিতে হবে—কারণ কুরআন কোন বিচ্ছিন্নগ্রন্থ নয়। এটি এসেছে সর্বময় প্রজ্ঞাবান থেকে-আল-হাকিম, সর্বময় মহাজ্ঞানী-আল-আলীম,আল-আযীয-কেউ যাকে পরাজিত করতে পারে না। তাহলে তাঁর গ্রন্থ এলোমেলো থাকবে আর ইচ্ছামত ব্যবহার করবে কিন্তু তিনি কিছুই দেবে না এর ভেতরে যা দিয়ে “সবাই একত্রিত হয়ে আল্লাহর রশিকে আকড়ে ধরব”?। হ্যা, এটাই তাদাব্বুরের বিষয়। এটাই আধুনিক তাফসীরের গভীরতর চিন্তার ধারা।

যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনকে একত্রিতভাবে শক্ত করে ধরতে বলেছে, সেই কুরআনের ক্ষেত্রে যেন একেবারে বক্র, অন্ধ, ও বিকৃত মানসিকতার কেউ ছাড়া উপলব্ধির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বাঁধা না থাকে সেটাই এই কুরআনের ভেতরেই দিয়ে দিয়েছে—কুরআনের বিষয়বস্তুর ও পারস্পারিক সম্পর্কের পূর্ণ ধারাবাহিকতা বিবেচনায়। এটাই কুরআনের বিষয়বস্তু ও কাঠামোগত সঙ্গতি –সম্পর্কগত মিলের ধারা (Thematic and structural coherence)।
 
এভাবে বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা এবং পারস্পারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে কুরআন পড়লে, কুরআনের কোথাও কোন অসংলগ্নটা বা অমিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। যার কারণে যেকেউ নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করলেই আপনি এর ভুল এবং অপপ্রয়োগকে ধরতে পারবেন। এই ধারায় কুরআনের উপলব্ধির মাত্রা সাধারণ বিচ্ছিন্ন উপলব্ধির বাহিরে এই সাজানোর পদ্ধতিতে যে কুরআনের জ্ঞানের এবং ইসলাম শিক্ষার মাঝে প্রজ্ঞা রয়েছে-যা উপলব্ধি ইসলাম উপলব্ধির জন্য একান্তই প্রয়োজন, এবং এর উপলব্ধিহীনতা আমাদের ভারসাম্যের পরিবর্তে চরমপন্থা ও আমাদের মাঝেও ইসলাম উপলব্ধির বাহিরে বিশৃংখলা বয়ে নিয়ে আসবে-যা আজকের দিনে আমরা অহরহ দেখছি।
যেই কুরআনের আবু লাহাব বা উতবার মত লোকেরাও মনোযোগ সহকারে শুনত রাতের আধারে লুকিয়ে। যেই কুরআন শ্রবণে মক্কার শ্রেষ্ট জ্ঞানী লোকদের দুটি অবস্থা হতো- হয়তো ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হতো অথবা কানে আংগুল দিয়ে ঐ স্থান ত্যাগ করতে হতো। এর কারণ কী? এর কারণ গর্বের ছিল না তাদের নিকট। তাদের নিকট ছিল তাদের উচ্চ মার্গীয় জ্ঞানের তুলনায় বিশাল এক সমুদ্রে সম্মুখে দাঁড়িয়ে যেন নিজেদের অর্জনগুলোকে অতি তুচ্ছতার সাথে তুলনা। কারণ তাদের ‘উপলব্ধি’টা ছিল অনেক প্রবল। তাদের এই উপলব্ধি ছিল তাদের নিজেদের শ্রেষ্ট জ্ঞানের তুলনায় আরেক এমন শ্রেষ্ট জ্ঞানের আঁধারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা যেন তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না কোনদিন।

এই উপলব্ধির অনেকগুলো কারণের মাঝে একটি ছিল এই কুরআনের ভেতরে গভীর চিন্তার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে একে অতি উচ্চ ঐশী গ্রন্থের সম্মুখে নিজেদের চরম সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি।
তাদের এই উপলব্ধির মূলে ছিল কুরআনে চিন্তার প্রখর উপাদান, শব্দ ও বাক্যের প্রাসঙ্গিক শক্তিমত্ত্বা, কুরআনের ধারাবাহিক চিন্তায় নিজেদের চিন্তার অযৌক্তিক উপাদানকে আকাশে তুলার মত উড়িয়ে দেওয়া আর তাদের উচ্চতর জ্ঞানের মাধ্যমে কুরআনের প্রবলতর শক্তিময় প্রজ্ঞার বর্ণনা তাদের পূর্বকালীন চিন্তনশক্তিকে ছাড়িয়ে যাওয়া এক মহাগ্রন্থ।

অথচ আমরা এর অনেক কিছুই জানি না। এই চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাফসিরের বাহিরে আরেক গভীরতর চিন্তার মাধ্যমে, উপলব্ধির এক সুশৃংখল ও ভিন্ন মাত্রায়। সেটাই ‘নাযম, তারতীব ও তাদাব্বুর’ – সম্পূর্ণ পবিত্র কুরআনের যোগসূত্র, বিষয়বস্তু এবং আয়াত ও সূরাসমূহের পারস্পারিক সম্পর্ক এবং এগুলোর মাঝে গভীরচিন্তার বিষয় – ব্যাখ্যার বাহিরেও গভীরতর চিন্তা, উপলব্ধির চরম মাত্রা, প্রাসঙ্গিক চিন্তার গভীর উপলব্ধি এবং কুরআনের ব্যবহারিক প্রজ্ঞার শিখর। এখন এই পূর্ণ কুরআনের উপলব্ধি দাঁড়িয়ে আছে এই সুশৃংখল, পদ্ধতিগত, বৈজ্ঞানিক ও কুরআনিক যুক্তির অধীনে।

মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী (রাহিমাহুল্লাহ) (1904-1997) বলেন তাঁর উস্তাদ মাওলানা ফারাহী (রাহিমাহুল্লাহ) এর এই পদ্ধতি উদ্ভাবনের বিষয়েঃ

‘আমার উস্তাদ যে মূলনীতি দিয়েছেন কুরআনের ব্যাখ্যায় সেগুলো বৈজ্ঞানিক, যৌক্তিক এবং সর্বসাধারণের উপলব্ধির উপযোগিতার ভিত্তিতেই। এবং এগুলো ব্যতীত কুরআনের সত্যিকার বার্তা ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করা বা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় ’

এই তাদাব্বুরে কুরআনে রয়েছে নাযম ও তারতীব(পারস্পারিক সম্পর্ক ও ধারাবাহিক বিন্যাস)এবং এদের পেছনে হিকমাহ বা প্রজ্ঞার সীমাহীন নিদর্শন ও বাস্তবিক দিকের সামগ্রিক প্রয়োগ

আপাতদৃষ্টির একটি ভিন্ন উদাহরণ

সূরা বাকারায় তালাকের ব্যাপারে আলোচনার পর আল্লাহ সালাত হেফাযতের কথা বলেছেন (২৩৮নং আয়াত)।

তালাকের সাথে সালাতে কি সম্পর্ক যে তালাকের পরে সালাতের কথা উল্লেখ করলেন আল্লাহ। এতের মাঝে যোগসূত্র কি? তালাকের পরেই সালাতের হেফাযতের কথার মাঝে ধারাবাহিক সম্পর্কটা কী?
কি? কুরআনকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে? নাকি আমাদের গভীর চিন্তা-ভাবনার অভাব?। আল্লাহ বললেনঃ প্রজ্ঞাময় কুরআন(সূরা ইয়াসিন) আর আমরা গভীর চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই প্রজ্ঞাকে খুজি যেন সবই খোলাসা পাওয়া উচিৎ! সাধারণ জিনিসই চিন্তা-ভাবনা ব্যতীত চোখে পড়ে না আর প্রজ্ঞা?—যা সর্বোচ্চ জ্ঞানের স্তর, নবী-রাসূলদের (আ) একটি উদ্দেশ্যই ছিল এই প্রজ্ঞাকে শিক্ষা দেওয়া। এসমস্ত কারণেই আল্লাহ এতো এতো বার তাঁর দেওয়া ব্রেইন নামক নেয়ামতকে বিভিন্নভাবে খাটাতে বলেছেন। তাঁর প্রজ্ঞাকে পেতে হলে তাঁর শর্ত মোতাবেকই যেতে হবে। এবার আসুন দেখি তালাকের আয়াতসমূহের সাথে সালাতের সম্পর্ক, প্রজ্ঞা এবং কুরআনের ধারাবাহিকতা ও পারস্পারিক সম্পর্ক (নাযম)।

বিবাহ মানে?

১। বিবাহ—একটি সম্পর্ক, কন্ট্রাক্ট
২। বিবাহের অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মাঝে সুকুন,মুওয়াদ্দাতাহ ও রাহমাহ (প্রশান্তি, ভালোবাসা ও দয়া)
৩। আত্মীয়তার সম্পর্ক আল্লাহর সম্পর্কের সাথে সম্পৃক্ত (সূরা নিসা-১) এবং এটা আল্লাহর তাকওয়ার সাথে সম্পর্কিত যা সূরায় দুইবার বলা হয়েছে(যা রেয়ার কেইস)।
৪। তালাক মানে বিচ্ছিন্ন হওয়া।

আর সালাত?

১। সালাহ মানে সংযোগ—মানে সালাতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি করি। (সূরা মুজাম্মিল-২০)
২। সালাত আল্লাহর হক
৩। সালাতকে হেফাযত করা (সূরা বাকারাহ-২৩৮) মানে তাঁর সাথে সম্পর্ক রাখা। (আর সালাত না পড়া মানে কুফুরী করা=আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। মুমিন ও কাফিরের মাঝে পার্থক্য–হাদীস)
৪। সালাত যাবতীয় মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে(=তাকওয়ার কাজ)

দুই জায়গার কমন বিষয় দেখুন

সামারিটা দেখার আগে আরো ভালোভাবে সালাতের উদ্দেশ্য, অর্থ, তাকওয়া উপলব্ধি আর আল্লাহর সাথে এসবের পারস্পারিক সম্পর্ক ভালো করে জানা থাকা দরকার।
১। দুই সম্পর্কের ভিত্তি আল্লাহ
২। এ সম্পর্ক তাকওয়ার ভিত্তিতে হয়
৩। অর্থাৎ আল্লাহ সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো, সেই আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে যেই সম্পর্ক (আত্মীয়তা, স্বামী-স্ত্রী), তাদের সাথেও সম্পর্ক ভালো।
৪। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভালো নেই বা একদমই নেই(সালাতের গাফলতি বা না পড়া), সেই আল্লাহর সম্পর্কের ভিত্তিতে অন্যান্য সম্পর্কও ভালো নেই (বিয়েতে অশান্তি ও তালাক)

এবার আসুন নীচের সামারিটা দেখি।

Salah and Talak Nazm
ইমেজটি এখানে স্পষ্ট করে দেখুন – http://tinyurl.com/qey7zxv

সুতরাং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেবল টিপস দিয়েই হয় না। আল্লাহর সাথে দুজনার ভালো সম্পর্কের ভিত্তিতে হয়। এইটা ঐটা হালাল-হারাম বললেই সম্পর্ক উন্নত হয় না। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক উন্নত করতে হবে, তাঁর যাবতীয় বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে, তবে তাঁর সম্পর্কের ভিত্তিতে যেই সম্পর্ক, তিনি ভালো রাখবেন। কেবল হালাল-হারাম ফতওয়াতে তাকওয়া বাড়ে না। আল্লাহর সাথে ভালো সম্পর্কের কারণে, তাঁর আদেশ-নিষেধ মানার কারণে তাকওয়া বাড়ে—তাঁর সাথে যাবতীয় বিষয়ের উন্নতি হয়।

নাযম এর অর্থ কী?

শব্দগত অর্থ – আবু তাহির মুজিব আদ-দারিয়াবাদী(মৃ-৮১৭হি) বলেনঃ

নাযম অর্থ সাজানো বা সুবিন্যস্ত করা এবং সংযুক্ত করা। এটি এমন পদ্ধতি যা একটি জিনিসকে অন্য একটি জিনিসের সাথে সংযুক্ত করে দেয়।

পরিভাষাগত অর্থঃ নাযম আল-কুর’আন

কুরআনের নাযম বলতে বুঝায় কুরআন এমন সামঞ্জস্য ও সংগতিপূর্ণ কিতাব, যার শব্দগুলো পদ্ধতিগতভাবেই সংকলিত এবং এতে কোন বিশৃংখলা নেই। এটা এমন কিতাব যার শব্দমালা সিস্টেম্যাটিক ও পারস্পারিক বিন্যাসসমৃদ্ধ যা একে অপরের সাথে সংযুক্ত। এতে কোন বিচ্ছিন্নতা, বা অসংলগ্ন বক্তব্য নেই। প্রত্যেকটি সূরাই একেকটি মৌল বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে এবং পূর্ণ কুরআনটিও সুন্দর গাঠনিক কাঠামোতেই লিপিবদ্ধ।

ইমাম বুরহানুদ্দিন আল-বাকাই বলেনঃ
“কুরআনের নাযম বিজ্ঞান হলোঃ কুরআনের বিভিন্ন অংশের মাঝে পারস্পারিক সম্পর্কের উৎস ও কারণ জানা। এটি বাগ্মীতার গোপন চাবি যা প্রয়োজনীয় পরিস্থিতির আলোকে অর্থকে বহন করে। এই বিজ্ঞানে দক্ষ ব্যক্তিকে কোনো সূরার মূল বিষয়বস্তুর উপলব্ধির উপর নির্ভর করতে হয়। কারণ ঐ সূরার প্রত্যেকটি বাক্যকে উপলব্ধি করতে এর প্রয়োজন রয়েছে”।
আবু বকর নিশাপুরী, আবুল কাশেম জুরজানী ও ফখরুদ্দিন আল-রাযীরা মনে করতেন যে, নাযম কে উপেক্ষা করে কুরআনের উদ্দেশিত অর্থ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

তাদাব্বুরের প্রাঙ্গণে

সূরা বাকারাহ প্রায় ১০ বছর ধরে নাযিল হয়েছিল। এর সাথে আরো অনেকগুলো সূরাও নাযিল হয়েছে একই সাথে। আমরা জানি যেকোনো আয়াত নাযিল হলেই রাসূল ﷺ বলে দিতেন এই আয়াতগুলো এই সূরায় যাবে, ঐ আয়াতগুলো অমুক সূরায় যাবে। এভাবে যদি ১০টি সুরা একই সাথে নাযিল হতো, তবে কোন আয়াত, কোন সূরায়, কোন জায়গায় যাবে, এটাও ছিল ওহী ভিত্তিক নির্দেশনা। তার মানে দাঁড়ায় আল্লাহ-ই এই সিস্টেমেই সূরাগুলো পূর্ণ আকারে ওহী ভিত্তিক নির্দেশেই নাযিল করেছেন ধীরে ধীরে কিন্তু লাওহে মাহফুযে যেটি আগেই পূর্ণাকারে ছিল (এবং প্রতি রামাদানে জিব্রাইল আঃ সম্পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করে শুনাতেন)

কিন্তু আমাদের অবচেতন মনে, পশ্চিমাদের ইসলাম বিদ্বেষীদের বা খুদ আমাদের বেশিরভাগ স্কলাররাই একটি বড় অভিযোগ করেন কুরআন বিশৃঙ্খল ও এলোমেলো।

যদি এই কুরআন এলোমেলো বা বিশৃখলই হয় তবে নাযিলকৃত আয়াতগুলোই বা কেন আল্লাহর নির্দেশে কোন সূরায় যাবে এভাবে বলা হতো?!! কেন এই নির্দেশ দীর্ঘ ২৩ বছর ধরেই চলবে? আল্লাহর নির্দেশেই যদি পূর্ণ কুরআন পূর্ণ আকারে আমাদের কাছে আসে তবে আল্লাহর এই নির্দেশের ভিত্তিতে এইভাবে সূরাগুলো সাজানোর উদ্দেশ্যই বা কী? আর কোন কিছু সাজালে তা বিশৃংখল বা এলোমেলোই বা থাকে কি করে?!! প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নাযিল হতে পারে কিন্তু লাওহে মাহফুযের সাজানো-যা আগেই পূর্ণাকারে ছিল এবং এই কুরআনের সাজানি তো একই…তাহলে বিশৃংখল হওয়ার কোন অবকাশই নেই, থাকতে পারে না এবং থাকা সম্ভবও নয়।

আমরা আল্লাহকে বলি ‘আল-আ’লিম’ – সর্বজ্ঞানী—তার মানে তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সবই জানেন। আর তিনি কীভাবে এটি নাযিল করবেন তাও তার নিকট জানা। কিন্তু আমরা যেহেতু ভবিষ্যত বা অতীত জানি না আর বর্তমানও সব জানি না, তাই অনেক কিছুতেই অনুমান করি—যা ঠিকও হতে পারে আবার ভুলও হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ সবই জানেন—তাহলে তার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই-ই। তাহলে আমরা যা পাইনি তার ভিত্তিতে অনুমান করে যিনি সবই জানেন তার ভুল ধরতে যাবো কেন? অথচ ওহীভিত্তিক নির্দেশে যেহেতু সাজানো হয়েছেই তাহলে একে বিচ্ছিন্ন বলব কেন?…আমরা জানি না কিন্তু তিনি তো সবই জানেন—তাহলে পরিকল্পনার মাধ্যমে ওহীভিত্তিক নির্দেশনায় সূরাগুলোর আয়াতও সাজানোর অবশ্যই কোন গোপন উদ্দেশ্য থাকবেই।

তিনি ‘আল-হাকিম’ – প্রবল প্রজ্ঞাবান। তিনি যা কিছু করেন প্রজ্ঞার সাথেই করেন। কুরআনের সাজানো পদ্ধতি বা নাযিল পদ্ধতি সবই প্রজ্ঞার সাথে করেছেন তিনি। এতে কেবল কতিপয় বিচ্ছিন্ন বাণীর সংকলন নয়।

আল-আযীয- সর্বাপেক্ষা শক্তিমানকিন্তু কুরআন সম্পূর্ণ আল্লাহর নির্দেশেই নাযিল হলো, তাঁর নির্দেশেই সবই সাজানো হলো কিন্তু তারপরেও এটি কি বিংশৃখল থাকতে পারে? তাহলে সর্বাপেক্ষা শক্তিমান ও প্রজ্ঞার অধিকারীর এ গুণগুলো কি ভুল বা এতে দূর্বলতা রয়েছে?…নাকুরআনও ওহীভিত্তিক সাজানোতে কোন বিশৃংখলতা নেই —কারণ এই সাজানোর নির্দেশনা পদ্ধতি তো আল্লাহ কুরআন নাযিল পূর্ণ হওয়া পর্যন্তই ছিল।
আসলেই কুরআন এলোমেলো নাকি আল্লাহর যেই ওহী ভিত্তিক নির্দেশের মাধ্যমে পূর্ণ কুরআন একত্রিত হয়েছিল- তাতে রয়েছে গভীর নির্দেশনা, হেদায়েতের অমিয় ঝর্ণাধারা এবং হিকমাহর উজ্জ্বল প্রাজ্ঞতা। এবং এই পূর্ণ কুরআনের এটা একটা অবিশ্বাস্য মু’জিযা। এই কুরআন নির্দেশনার মাধ্যমে যেভাবে দীর্ঘ ২৩ বছরে নাযিল হয়েছিল তা ছিল – পূর্ণ ধারাবাবিকতা বিবেচনায়, সুংশৃখল, পারস্পারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এবং এতো কোন বিশৃঙ্খলতা তো নেই-ই বরং আমরা যদি এর ধারাবাহিকতা ও পারস্পারিক সম্পর্ক উপলব্ধি করতে পারি তবে কুরআনের ভেতরের স্বাদকে আচ্ছাদন করতে পারবো আরো গভীরভাবে। বিশৃংখলতার বিপরীতে এতো স্বাদ, এতো গভীরতা, এই গভীর প্রাজ্ঞতা ও মু’জিযা লুকিয়ে রয়েছে এই কুরআনের এতো সুগভীর সুশৃখলতার মাঝে যে তাতে আল্লাহকে সর্বজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ, উত্তম পরিকল্পনাকারী তা অভাবনীয়ভাবেই টের পাবো কুরআনের প্রতিটি আয়াতে ও সূরাগুলোর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের মাঝে।
এই কুরআনের সাজানো পদ্ধতিই যে চরম শৃঙ্খল এবং জ্ঞানের বিশালতার উচ্চমার্গীয় মু’জিযার হিকমাহর প্রকাশ যার সাথে কুরআনের স্বাদ, প্রজ্ঞা, এবং মিশে আছে আল্লাহর উচ্চমার্গীয় জ্ঞানের এক অসীম নিদর্শন – তা কি আমরা জানি?

সম্পূর্ণ কুরআন একটি তাসবিহর মালার মত। এর একেকটি আয়াত, একেকটি সূরা, যেন একেকটি পুতিস্বরুপ সঞ্চিত হয়ে পূর্ণ মালায় রুপ পেয়েছে পরিপূর্ণরুপে। এর একটি দানা ছিড়ে গেলে কি হবে?…এর পূর্ণ ধারাবাহিকতা ও একেকটি পুতির সাথে আরেকটি পুতির যে সুন্দরতম নকশা, সম্পর্ক ও কার্যকারিতা ছিল, তা নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে কি এই মালার পূর্ণ স্বাদ, সৌন্দর্য ও ব্যবহারিক উপভোগ্যতা থাকে? না।

তেমনি পবিত্র কুরআনেরও রয়েছে এরকম সুশৃংখল পরিপূর্ণতা এবং এটি রয়েছে কয়েকভাবে। সুতরাং এই পরিপূর্ণ শৃংখলার সাথে যদি একে উপলব্ধিতে না আনা হয়, তবে এর উপলব্ধিতে থাকবে অপূর্ণতা, প্রজ্ঞায় থাকবে সীমাবদ্ধতা, প্রায়োগিক দিক হবে বিচ্ছিন্ন আর এর যথেচ্ছা অপব্যবহারও হতে পারে বিচ্ছিন্নভাবে কুরআনের আয়াতগুলোর নিজেদের মত করে উপলব্দির কারণে-এবং ফেরকা বা প্রচূর মতবিরোধের কারণ এইটাই-বিচ্ছিন্নভাবে সূরা বা আয়াতগুলো পড়ার কারণে- নিজেদের ইচ্ছামত পূর্বাপর পারস্পারিক তারতীব-ধারাবাহিকতা বজায় না রেখে ব্যাখ্যার কারণে।

এখানে একটতা উদাহরণ দেখা যাক।

THEORY OF RING COMPOSITION


রিং থিওরী বর্ণনা করেছেন ম্যারি ডগলাস(Mary Douglas) তার বই “Thinking in Circles: An Essay on Ring Composition” তে । রিং থিওরীর গঠন হলো দুটি জিনিসের প্রথম এবং শেষ—এ দুটির মাঝে মিল বা সাদৃশ্য থাকতে হবে। এটা সার্কেল বা বৃত্তাকার গোলকের মত বা আয়না সদৃশ – যা একটা জিনিসকে নিজের দিকেই ফিরিয়ে দেয় বিপরীতভাবে। বিষয়বস্তু বা জিনিসের প্রধান অংশ থাকে মাঝে আর দ্বিতীয়াংশ যেন প্রথমাংশের ঠিক বিপরীত সাজানিতে রয়েছে।

দুইটা অংশের মাঝে বিষয়বস্তুর সুস্পষ্ট যোগসূত্র থাকতে হবে এবং এভাবে একটা অংশ আরেকটা অংশকে পরিপূর্ণ করে একে সমাপ্তিতে নিয়ে আসে। এবং এই মূল বিষয়বস্তুর সাদৃশ্যের সাথে এর ভেওরের কাঠামোরও এরকম সাদৃশ্য থাকবে।

সূরা বাকারাহ দিয়ে আমরা এর উদাহরণ দেখবো। এটি প্রায় ১০ বছরে নাযিল হয়েছিল নিরক্ষর মুহাম্মাদ সা এর উপর। এটি কুরআনের সর্ববৃহৎ সূরা যার আয়াত সংখ্যা ২৮৬টি। একে সূরার সেকশন আকারে ভাগ করলে ৯টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে এর বিষয়বস্তু (Theme/Topic) অনুযায়ী।

1. ঈমান বনাম কুফুর (1 – 20).
2. আল্লাহর সৃষ্টি ও জ্ঞান (21 – 39).
3. বনী ইজরাঈলদের শরীয়া দেওয়া (40 – 103).
4. ইব্রাহীম আঃ এর পরীক্ষা (104 – 141).
5. নতুন কিবলা – কা’বা শরীফ (142 – 152).
6. মুসলিমদের পরীক্ষা করা হবে (153 – 177).
7. মুসলিমদের শরীয়া দেওয়া (178 – 253).
8. আল্লাহর সৃষ্টি ও জ্ঞান (254 – 284).
9. ঈমান বনাম কুফুর (285 – 286).

নতুন করে এক সাজালে পাওয়া যায় এভাবে।

__1. ঈমান বনাম কুফুর (1 – 20).
________2. আল্লাহর সৃষ্টি ও জ্ঞান (21 – 39).
_____________3. বনী ইজরাঈলদের শরীয়া দেওয়া (40 – 103).
_________________4. ইব্রাহীম আঃ এর পরীক্ষা (104 – 141).
5.—————-নতুন কিবলা – কা’বা শরীফ (142 – 152).
_________________4. মুসলিমদের পরীক্ষা করা হবে (153 – 177).
_____________3. মুসলিমদের শরীয়া দেওয়া (178 – 253).
________2. আল্লাহর সৃষ্টি ও জ্ঞান (254 – 284).
__1. ঈমান বনাম কুফুর (285 – 286).
rrইমেজটি স্পষ্ট করে দেখুন এখানে – http://tinyurl.com/plme4lm

সুতরাং দেখতে পাচ্ছেন কীভাবে এর গঠন হচ্ছে এবং বিপরীতে গিয়ে সেই আগের পজিশনে ফিরে আসছে কিন্তু এর মাঝে হেদায়েতের পূর্ণ ধারা বর্ণিত আছে সুনিপুনভাবে। বনী ঈজরাইলদের বর্ণনার সাথে সাথে তাদের ব্যর্থতা, অবাধ্যতা ও এসব কীভাবে হয়েছে উদাহরণ দিয়ে বুঝানো হচ্ছে- তাদের পৃথিবীতে সর্বোচ্চ লেভেলের সম্মান থাকা সত্ত্বেও তাদের এসব কাজের দরুন উম্মাতে মুসলিমকে ইসলামের দায়িত্ব দেওয়া হলো…। কিন্তু তারাও যদি বণী ইজরাঈলদের মত করে তবে তারাও কুফুরিতেই ফিরে যাবে এবং নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

এটা মোটাদাগে নাযম ও তারতীব দেখানো হল। আপনি যখন এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত পড়তে যাবেন তখন দেখবেন এগুলোর সাথে কত প্রজ্ঞা বা হিকমাহ জড়িত রয়েছে, কত সুনিপুন গঠনগত বিন্যাস-কাঠামো, এর ভাষা, এর প্রত্যেকটি যোগসূত্র এবং ধারাবাহিকতার মাঝে নাযিলের প্রেক্ষাপট প্রত্যেকটি আয়াত এবং সর্বসাকুল্যে সূরা পূর্ণটিই একটি বড় বিষয়বস্তুকে ঘিরেই এই ৯টি সাব-থিম বা উপ-বিষয়বস্তু আবর্তিত হচ্ছে অথচ তাদের মাঝে কোনো ভাঙ্গন নেই, সবাই একই তাসবিহর মালায় বিজড়িত হয়ে আছে। এভাবে প্রত্যেকটি সূরা যেন একেকটি সরল পথ, যার কোথাও ভাঙ্গন নেই, পূর্ণ পথটি একসাথে মিলিত আকারে চলেছে গন্তব্যের শেষ পর্যন্ত—যার উদ্দেশ্য অভিন্ন। 

আরো অবাক হবেন এই দেখে যে এই ৯টি মূল বিষয়বস্তুর প্রত্যেকটিতেই এই রিং থিওরী রয়েছে অর্থাৎ সার্বিক ১টি রিং, আবার প্রত্যেকটির ভেতরেই রয়েছে একটি করে মোট ৯টি রিং। সুবহানাল্লাহ!!

প্রয়োজনীয়তা – ইতিহাস ও সমকালীন

 

তাফসীরে এ নাযম(Coherence) বা যোগসূত্রের ধারাটি পূর্ণাঙ্গতার দিক থেকে একেবারেই নতুন বলা যায় । মাওলানা হামিদুদ্দীন ফারাহী (রাহিমাহুল্লাহ)(1863-1930) ই প্রথম ব্যক্তি যিনি একে বৈজ্ঞানিক, যৌক্তিক এবং পূর্ণাকারে রুপ দেওয়ার ক্ষেত্রে পাওনিয়ার বা অগ্রগণ্য বলতে হয়। এর আগেও এ নিয়ে কথা এসেছে কিন্তু তা বিচ্ছিন্নভাবে এবং একে সুশৃংখলতায় নিয়ে আসার মত কেউ চেষ্টা করেনি যা পূর্ণ কুরআনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে সিস্টেমের ভেতরে আনা যায়। Abu-Hayyan, Allamah Abu Jafar Ibn Zubayr, একটি বই সংকলন করেছিলেন যা al-Burhan fi Munasabat al-Suwar al-Quran (The Conclusive Proof Regarding the Correspondence in the surahs of the Holy Quran) নামে ছিল। এবং ফারাহী (রাহিমাহুল্লাহ) এর সমকালীন Sheikh Burhan al-Din Baqai রচনা করেছিলেন Nazm al-Durar fi Tanasub al-Ayi wa al-Suwar (Arrangement of the Pearls regarding the Correspondence of the Verses and the Surahs)।

এছাড়া ইমাম সুয়্যুতী এবং ইমাম ফখরুদ্দিন আল-রাযী (রাহিমাহুমুল্লাহ) ও যে চেষ্টা করেছিলেন এবং এর প্রমাণও রেখে গেছেন।

প্রাথমিক অবস্থায় মাওলানা ফারাহী (রাহিমাহুল্লাহ) যখন সূরা বাকারাহ এবং সূরা আল-কাসাস এ যোগসূত্র পেলেন এবং তখন তিনি আরো দৃঢ়চিত্ত হলেন। এটা ছিল ফারাহীর জীবনের প্রাথমিক অবস্থায়। কিন্তু ক্যারিয়ারের কারণে তিনি প্রায় ১০ বছর বিরত ছিলেন। এরপর কুরআনের এই অঙ্গনে তিনি পুনরায় আত্মনিয়োগ করেন নিজেকে। প্রায় ১ বছরের পরিশ্রমের ফল হিসেবে তিনি একটা শক্ত অবস্থানগত সিদ্ধান্তে পৌছান। কিন্তু তিনি তখনই একে সম্মুখে আনতে চাচ্ছিলেন না। তিনি আরো দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণায় নিয়োজিত রইলেন। তার কাছে সবই স্পষ্ট ছিল, প্রমাণের কোন ঘাটতি ছিল না। কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন বড় ধরণের রিসোর্স হলে সবার সম্মুখে নিয়ে আসবেন। এভাবে চলতে চলতে তিনি সব সময়ই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন যেকোনো ধরণের অজ্ঞতা থেকে।

যেসব বিবেচনায় কুর’আনের যোগসূত্র উদ্ভাবনে দায়িত্ব নিলেন


মাওলানা হামিদুদ্দিন ফারাহী-তাঁর নাযম আল-কুরআনের ভূমিকায় ৬টি মূলনীতি আকারে পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন যেসব কারণে তিনি এদিকটাতে মনোযোগী হলেন কুরআনের নাযম উদ্ভাবনে।

১। তিনি গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন যে কুরআনের টেক্স উপলব্ধির ক্ষেত্রে যত ভিন্নতা বা মতবেধ আছে সেগুলো মূলত হয়েছে “কুরআনের নাযম” বা কুরআনের যোগসূত্র আমলে না নেওয়ার জন্যই। কুরআনের আয়াতগুলোকে যদি স্পষ্টাকারে সাজানো পদ্ধতিতে এনে পড়া হতো প্রত্যেকটা সূরার মূল বিষয়বস্তু বা Theme এর আলোকে, তাহলে সব ধরণের সম্ভাব্য পার্থক্যমূলক ভিন্নতাই দূর হয়ে যেতো। যেন সকলেই একই পতাকাকে উত্তোলন করছেন, একটি একক বাক্যকে শক্ত করে ধরে রাখছে – “পবিত্র কালিমার উদাহরণ এমন যার মূল গভীরের গ্রথিত, যার শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত”। কিন্তু আমরা একই কালিমার আল্লাহর কালামকে একত্রিত হয়ে ধরতে বলা হয়েছে—

“তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না” সূরা আলি-ইমরান-১০৩

এরকম বিষয়ে কীভাবে সকল ধরণের ভিন্নতা থেকে বের হয়ে আসা যায়? আল্লাহর রজ্জুকে সবাই শক্ত বলেছে—“মিথ্যা যার পাশে আসতে পারে না সম্মুখ বা পেছন থেকে” । কিন্তু প্রত্যেক দল একে নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করছে এবং এভাবে বিভিন্ন ভ্রান্ত ফেরকার উদ্ভব হচ্ছে, কুরআনের আয়াতের সঠিক অর্থ থেকে নিজেরাই বিচ্ছিন্ন ও পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে—যেখানে কুরআনের একমাত্র বিশুদ্ধ উপলব্ধি হবে কুরআনের পারস্পারিক যোগসূত্রের ধারাবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমেএভাবে নিলে কেউ কুরআনের ‘আয়াতের প্রসঙ্গকে দূর করে নিজেদের খায়েশমত অর্থ নিতে পারবে না’। আর এভাবে কুরআনের সম্মুখ বা পেছন থেকে যেকোনো ধরণের আক্রমন থেকে মুক্ত থাকবে।

২। রাফেজী এবং খারেজীরা কুরআনের বিরুদ্ধ অভিযোগ দিতে যে কুরআন কোন সুশৃংখল কিতাব নয়। মুসলিম স্কলারদের এদের বিরুদ্ধবাদিতার উচিত জবাব দেওয়া উচিত ছিল যেভাবে আল্লাহ দিয়েছিলেনঃ

“…তাদের মুখনিসৃত বাক্য কি উদ্ভট!” (সূরা কাহাফ-৫)

এবং আল্লাহ আরও বলেনঃ

…এবং কখনই আল্লাহ মুমিনদের বিপক্ষে কাফিরদেরকে বিজয়ী করবেন না। (সূরা নিসা – ১৪১)

অথচ সত্য ছিল স্পষ্ট কিন্তু মিথ্যাই এতোদিন জয় পেয়ে আসছিল। এজন্য আমাকে এর জন্য প্রস্তুত হতে হলো।

৩। যোগসূত্র যেকোনো কথা বা ভাষণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু একে যদি কেটে ফেলা হয়, তবে ভাষণ বা কথার ভেতরগর গুরুত্বপূর্ণ অর্থ ও ব্যবহারই হারিয়ে যাবে। যেকোনো পূর্ণ ভাষণই পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে। একারণে খন্ডাকারে কোন পূর্ণ বকৃতার অংশ নিলে এর অর্থই হারিয়ে যাবে। এভাবে নিলে আল্লাহর কথাকেও বিকৃত করা যাবে মনের মত করে। তাহলে আমাদের অবস্থাও আহলে কিতাবীদের মতই হবে যারা তাদের কিতাবকে নিজেদের ইচ্ছামত বিকৃত করতো।

৪। কুরআন নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে এটি অল্প অল্প করে নাযিল হয়েছে, প্রয়োজনের ভিত্তিতে, বিভিন্ন সময়ে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এটি করার উদ্দেশ্য ছিল কুরআনের অনুসারীরা যাতে এটি বুঝতে পারে সেজন্য। আল্লাহ বলেনঃ

“কাফিররা বলেঃ কুরআন তাঁর নিকট একেবারে নাযিল হলো না কেন? (এভাবে অল্প অল্প করে নাযিল করেছি) এটি দিয়ে তোমার অন্তরকে মজবুত করার জন্য…” (সূরা ফুরকান-৩২)

যখনই একটি সূরা নাযিল হতো, এটি সাজানো হতো নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে(Order) এবং এর অর্থও কুরআনে বিশদভাবেই বর্ণনা করা হতো। আল্লাহ বলেনঃ

তা সংরক্ষণ ও পাঠ করার দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন আমি তা (জিব্রাইলের মাধ্যমে) পাঠ করি, তুমি সেই পাঠের অনুসরণ করো। অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই। (সূরা কিয়ামাহ – ১৭-১৯)

সুতরাং আল্লাহ নিজেই বলে দিচ্ছেন যে – যখনই কুরআনের কোনো সূরা নাযিল হয়ে পূর্ণ সূরা হতো, আল্লাহ নিজেই এটিকে নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে সাজাতেন এবং এ অনুসারেই তিনি প্রয়োজনের ভিত্তিতে এর মাঝে বিশদ ব্যাখ্যাও অন্তর্ভূক্ত করে দিতেন।

যেকোনো আয়াত নাযিল হলে রাসূল (সা) একে একদম নির্দিষ্ট স্থানে রাখতেন নাযিল অনুসারে। কোনো সূরা পূর্ণ হতে বাকী থাকলে তিনি অস্থির হতেন। এটা হতো কারণ তাঁর দায়িত্বের ভার ছিল মানুষকে এর মেসেজ যতদ্রুত পারা যায় দেওয়া। আল্লাহ তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেনঃ

“…তোমার প্রতি আল্লাহর ওহী সম্পূর্ণ হবার পূর্বে তাড়াতাড়ি করো না এবং বলোঃ আমার রব,আমার জ্ঞানকে বৃদ্ধি করে দিন”। সূরা ত্বহা-১১৪

ঠিক এই কারণেই আল্লাহ তাঁর প্রজ্ঞার দ্বারা জানতেন যে শরীয়ার নির্দেশনায় শ্লথন(Relaxation) নাযিল করা দরকার। এটা করা হয়েছিল মানুষের আধ্যাত্বিক প্রকৃতির দূর্বলতার কারণে।

একারণেই কুরআন প্রাথমিক নির্দেশনার পরেই প্রশমনমূলক আয়াতও নাযিল করেন এই মানবিক দূর্বলতাকে বিবেচনা করে। আল্লাহ বলেনঃ

“আমি ইতোপূর্বে আদমের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম; কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল; আমি তাকে দৃঢ় সংকল্পরুপে পাইনি”। (সূরা ত্বহা-১১৫)

৫। পূর্বের লেখাতে আমি উপস্থাপন করেছি যে কুরআনে যোগসূত্রের বিষয়টি প্রকৃতই সত্য। এমনকি রাসূল (সা) এর অনেক হাদীস-ই আমাদের জানাচ্ছে যে কুরআনের কোন আয়াত নাযিল হলেই রাসূল (সা) এর সূরা ও অবস্থান নির্দেশ করে দিতেন। অর্থাৎ এটা রাসূল সা এর অধীনেই হতো। এমনকি কিছু হাদীস এটাও বর্ণনা করেছে যে, সূরাটি পূর্ণ হলে জিব্রাইল আঃ একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণ তিলাওয়াত করে রাসুল (সা) কে শুনাতেন। এর মানে এটাই বুঝাচ্ছে যে, এটা আল্লাহর নির্দেশই রাসূল (সা) অনুসরণ করতেন। আর আমরা সমস্ত উম্মাহ মিলেও এ কারণেই ঠিক একই ধরণের টেক্স পাই যা ঠিক একই ধরণের ধারাবাহিক সাজানিতে বিদ্যমান।

৬। আমার কুরআনের নাযম বা যোগসূত্রের ব্যাপারে দৃঢ় হওয়ার আরেকটি কারণ ছিল এই যে পূর্ববর্তী অনেক স্কলার, যাদের অন্তরকে কুরআন উপলব্ধির জন্য আল্লাহ প্রশস্ত করে দিয়েছলেন তাদের স্বীকারুক্তি। তারা কুরআনের গহীনে লুকিয়ে থাকা এ বাস্তবতার দিকে কিছুটা দৃষ্টিও দিয়েছিল। তারা কুরআনকে মূল্যায়ন করেছে যে এর ভেতরে রয়েছে প্রজ্ঞাপূর্ণ ভান্ডার এবং এও বিস্ময় প্রকাশ করেছে যে তা কুরআনের যোগসূত্র ও সাজানির ভেতরে দিয়ে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তারা চেষ্টা করেছে, সাধনা করেছে একে খুঁজে পেতে এবং সফলও হয়েছিল অনেকটা। যেরুপ আমরা দেখি ইমাম সুয়্যুতি ও ফখরুদ্দিন আল-রাযী (রাহিমাহুমুল্লাহ) এ নিয়ে আলোচনাও করেছেন।

এগুলো বিবেচনায় আমি কুরআনকে গভীর চিন্তা নিয়ে এগুতে থাকি। আমি মনে করি কুরআনের নাযম নিয়ে না আগালে কুরআনের গভীর চিন্তা না আসাই স্বাভাবিক।

এগুলো ছিল উস্তাদ ফারাহী (রাহিমাহুল্লাহর) চিন্তাধারা যা তাকে এ পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এবং তাঁর বইতে(মুকাদ্দিমা নাযম আল-কুরআন) আলোচিত হয়েছে আরো বিস্তারিত মূলনীতিসহ।

আর কুরআনের নাযম বা যোগসূত্র সম্পর্কে সাহাবারা (রা) কি চুপ ছিলেন বা জানতেন না? বা আমাদের বেশিরভাগ স্কলারই কেন এ বিষয়ে চুপ ছিলেন? এ বিষয়ে আলোচনা সামনে আসছে।
এর পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দেখলাম যে ফারাহীর উত্তরসূরী মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী(রাহিমাহুল্লাহ)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি এ দিককে পূর্ণ এগিয়ে নিয়ে পূর্ণাকারে তাফসীর লিখেন। কিন্তু এদিক বিবেচনায় ইসলাহী এবং ডা. এসরার আহমাদ কিছুটা উন্নত করেছে এ চিন্তাধারাকে যা ফারাহীর চিন্তার বাহিরেও কিছুটা বিস্তৃতি বলা যায়।

পরবর্তী পর্যায়ে এদিক নিয়ে আরো অনেকেই কাজ করেছেন। আলাউদ্দিন আহমাদ বিন আলী আল মুহাইমী (মৃ-৮৩৫হি), মুবারাক বিন খাইজার নাগুরীভ(মৃ-১০০১হি),মানুয়ার বিন আব্দুল হামিদ লাহুরী (মৃ-১০১১হি), সানাউল্লাহ অমৃতসরী, আশরাফ আলী থানবী, মাওলানা মওদূদী ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রাহিমাহুমুল্লাহ)-ও এসব বিষয়ে আলোচনা করেছেন ও অনেকেই তাফসীর লিখেছিলেন এবং অনেকে নতুন চিন্তাও যোগ করেছেন।

সুতরাং যারা বলে এ বিষয়ে চিন্তা বেঁচে নেই বা ধারা চলছে না, তারা ভুলই বটে। বিশেষত এতো এতো আগে যে এ বিষয়ে তাফসীরও লেখা হয়েছে এবং চিন্তার উন্নতি হতে হতে আমীন আহসান ইসলাহী পর্যন্তই পূর্ণাংগরুপে এসেই থেমে থাকেনি বরং আরো উন্নত হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ এবং বর্তমানে বিশেষত পশ্চিমাবিশ্বে এটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত যা নিয়ে অনেক পিএইচডি-ও হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বের বিখ্যাত মুহাদ্দিস শাইখ আকরাম নাদভীর রয়েছে এই তাফসীরের উপর কোর্স, উস্তাদ নুমান আলী খান একে যেন বিশ্বদরবারে পরিচিত করছেন তাঁর কুরআনের অসাধারণ ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে, এবং অন্যান্য শাইখরাও যেমন শাইখ আব্দুন নাসির জাংগদা-রাও এ ধারা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন এবং মুহাম্মাদ সালা-রা তো সেমিনারও করেছেন এ ধারার উপলব্ধি ও প্রজ্ঞা নিয়ে।
বর্তমানে যেমন আমেরিকান কুয়েত ইউনিভার্সিটির এরাবিকের প্রফেসর Raymond K. Farrin মূলত ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন এই দিককে গবেষণা করে দেখার ফলেই। তিনি সূরা বাকারাহর উপর (Surat al-Baqara: A Structural Analysis) যখন প্রথম ভাষাতাত্ত্বিক যোগসূত্রের বিশ্লেষণ করে অসাধারণ ফল পান এবং এতেই আগ্রহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে বলেন—এই বই কোন মানুষের লিখিত হতে পারে না।

Neal Robinson তাঁর কুরআন নিয়ে বিখ্যাত বই Discovering the Qur’an: A Contemporary Approach to a Veiled Text তেও এ বিষয়ে আলোচনার নতুন মাত্র যোগ করেছেন তুলনামূলকভাবেই। তিনি আমীন আহসান ইসলাহী এর তাদাব্বুরের ধরণ নিয়ে আলোচনা এনেছেন The Order of the Surahs: Islahi’s Explanation ১৩ তম অধ্যায়ে। এবং তিনি সূরা বাকারাহর পূর্ণ সূরাটিকে এ ধারায় চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করে সফলও হন।

Salwa El-Awa এর পিএইচডির বিষয়-ই ছিল এই ধরণের উপর। তাঁর বইতে সব ইতিহাস তুলে ধরে এনেছেন এবং চমৎকার ব্যাখ্যাও করেছেন। বইটির নাম Textual Relations in Quran: Relevance Coherence & Structure।

এর পূর্বে Mustansir Mir ও পিএইচডি করেন যা ছিল ইসলাহীর নাযম এর বিশ্লেষণের উপর। তাঁর বই ছিল – Cohernence in the Quran; A study of Islahi’s Concept of Nazm In Tadabbur-i-Quran – যা সবাই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন।

আর মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী তাঁর তাফসীরের পূর্ণাংগ রুপ দেওয়া সম্পর্কে বলেনঃ
“তাফসীর তাদাব্বুরে কুরআনকে বাস্তবে রুপ দেয়ার পিছনে আমার জীবনের ৫৫টি মূল্যবান বছর গড়িয়ে গেছে। তন্মধ্যে ২৩ বছর কেটেছে শুধু পান্ডুলিপি রচনায়। এর সাথে অনুসৃত উস্তাদ মরহুম মাওলানা হামীদুদ্দীন ফারাহীর কুরআন বিষয়ক চিন্তা-গবেষণার সময়কাল যুক্ত করা হলে তাদাব্বুরে কুরআন গ্রন্থটিকে প্রায় শতাব্দী জুড়ে চিন্তার স্বার্থক ফসল বলা যায়…”
তিনি মোট ৮টি ভলিউমে উর্দূতে এর সমাপ্তি করেন। অবশ্য পরে আরো একটি খন্ড বৃদ্ধি পায় কেবল কুরআনের নাযম নিয়ে একটা খন্ড তৈরি করতে – এর সূচী এবং সব অংশগুলোকে একত্রিত করে আলাদা একটা খন্ড করার জন্য।

শেষের দিক থেকে কয়েক খন্ড ইংলিশে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সাইটে। এছাড়া কিছু অডিও করেও ইউটিউবে ছাড়া হয়েছে।

আমাদের দেশে বাংলাভাষায় তাদাব্বুরে কুরআনের ভূমিকাসহ বর্তুমানে মোট দুই খন্ড প্রকাশিত হয়েছে আধুনিক প্রকাশনী থেকে। তাদের কাটাবনের শাখাসহ অন্যান্য জায়গায় পাওয়া যায়।

তাদাব্বুরে কুরআন লেখার উদ্দেশ্য কী?


“আমি এ তাফসীর লিখার পিছনে আমার মূল উদ্দেশ্য এমন একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করা যার বিবরণে যাবতীয় অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা, অন্যায় পক্ষপাতিত্ব প্রায় ক্রটি-বিচ্যুতির ছোবল এড়িয়ে স্বাধীন ও মুক্তমনে প্রতিটি আয়াতের সঠিক মর্ম, আসলভাব ও যথার্থ আবেদন চিহ্নিত করা হবে।”

এ উদ্দেশ্যে তিনি যেসব সোর্স ব্যবহার করেছেনঃ

প্রথমত – “কুরআনের ভাষা, এর বাচনভঙ্গি, আয়াতসমূহের পারস্পারিক যোগসুত্র, প্রমাণ সিদ্ধ বক্তব্য ও দৃষ্টান্তের উপস্থাপনা।”

দ্বিতীয়ত – “হাদীস, পূর্বতন আসমানী গ্রন্থ, তাফসীরের কিতাব ইত্যাদি কুরআন বহির্ভূত মাধ্যমসমূহ অনুসরণ করেছি। এগুলোর সাহায্য আমি নিয়েছি বটে তবে, ভিতরগত মাধ্যমের অধীন হিসেবে।”
অর্থাৎ কুরআনের স্ট্রাকচার-ধরণ, গঠন, ভাষা, ইত্যাদিকে তিনি প্রাথমিক সোর্স হিসেবে নিয়েছেন এবং অন্যান্য সোর্স তিনি নিয়েছেন এদেরকে ভালোভাবে উপলব্ধির জন্য যেন এগুলো দিয়ে কুরআনকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধির দোয়ার খুলে যায়। এজন্য যেখানে আয়াতের সামগ্রিক দিক বিবেচনায় স্পষ্ট, সেখানে অন্যান্য সোর্স তিনি নেননি-নেয়ার প্রয়োজন হয়নি বলেই।

এ মাধ্যমসমূহকে ব্যবহারিক দিকের গভীরতর তাৎপর্য ও উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা

১। কুরআনের ভাষা

“কুরআন কারীম আরবী ভাষায় নাযিল করা গ্রন্থ। তবে এর ভাষ্য কথ্য কিংবা নিম্নমানের ভাষার দোষ-ক্রটি থেকে মুক্ত। কার্যত কুরআনের বাচনভঙ্গি, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, যুক্তি-প্রমাণ, শব্দ ও বাক্যের পরস্পর গাঁথনি এবং রচনাশৈলি এমন অলঙ্কার শোভিত যাকে মু’জিযা তথা অলৌকিক আখ্যায়িত করা ছাড়া উপায় নেই। এ জাতীয় কালাম রচনা করা জিন-ইনসান কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রচলিত আরবী বাকরীতির পুরোপুরি অনুসরণ না করে আল-কুরআনের বাগধারা মূলত নিজস্ব ও স্বতন্ত্র গতি অনুসরণে প্রবাহিত, যাকে মানবীয় বাগ-ব্যঞ্জনার সাথে তুলনা করা অর্থহীন। কুরআনের বাচনভঙ্গি কি পরিমাণ অলঙ্কারসমৃদ্ধ আরবের প্রখ্যাত কবি লাবীদের ঘটনায় কিঞ্চিত অনুমান করা যায়”।

কবি লাবীদ ছিলেন আরবের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত কবি যার কবিতা শ্রেষ্ট রচনা হওয়ায় ক্বাবা ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হতো। পরবর্তীতে ইসলামের আগমনের যখন তিনি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন তখন তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। তিনি যতই কুরআন পাঠ করেন, এর অলৌকিক ব্যঞ্জনা ভাষা অলংকারের অনাবিল মূর্ছনা তাকে বিমোহিত করে। তিনি কবি। তিনি ভালো করেই জানেন নিখুঁত উপমার প্রয়োগ কত নিপুন হতে পারে। মানবরচিত কোন কথা এর ধারে-কাছে যাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কুরআন নাযিলের পর তিনি আর কবিতা লেখেন নি। যিনি ছিলেন আরবের কবিত্বের সেরা ব্যক্তিত্ব, আলংকারিক মাত্রার প্রকৃতি, তিনিই সবকিছু ছেড়ে দিলেন কুরআনের পর।

কেউ একজন জিজ্ঞেস করেছিল- আপনার কাব্যচর্চার প্রতি বিমুখ হওয়ার কারণ কি?
স্বল্প ভাষণ জ্ঞানী লোকের লক্ষণ। তিনি উত্তর দিলেনঃ আ বা’দাল কুরআন? অর্থাৎ কুরাআনের পরও কি কিছু আছে?!

ভাষা অলংকারের প্রতিক, সাহিত্যের যুক্তির শিরোমণি কাছ থেকে এটাই ছিল অপকট উক্তি।
“কুরআনে কারীমের ন্যায় উচ্চমানের ভাষাশৈলি সমৃদ্ধ ও অলঙ্কার শোভিত কালামের সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতা আন্দাজ করা কেবল তরজমা-তাফসীর, কিংবা ভাষাজ্ঞানের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এর জন্য চাই বরং উচ্চতর মেধা-মনন, ভাষার গভীরতা অধিকন্তু যে ভাষার কালাম সে ভাষার নিখুঁত পান্ডিত্য। বলাবাহুল্য কোনো ভাষায় পান্ডিত্য ও বুৎপত্তি অর্জন করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। এর জন্মগত প্রেরণা, সূক্ষ্ণ মননশীলতার সাথে কাঙ্ক্ষিত ভাষায় পান্ডিত্য অর্জনে বিরামহীন সাধনা অপরিহার্য…”
কিন্তু আরবী ভিন্নভাষীদের জন্য এটি অনেক কঠিন।

আমিন আহসান ইসলাহী (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেন-
“কিন্তু ভাষা বিশেষত কুরাআনী ভাষার ব্যাপারে অপর সমস্যা হলো যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছিল সে ভাষা আজ কোথাও প্রচলিত দেখা যায় না”।

কুরআন কারীম বর্তমান আরবী বা মিশরীয় পত্র-পত্রিকার ভাষাকে বাহন বানিয়ে নাযিল হয়নি। নাযিল হয়েছে বরং ইমরাউল কায়েস, আমর বিন কুলসূম, যুহাইর, লবীদ প্রমূখ কবি-কাব্যকার এবং কুস বিন সায়েদার ন্যায় শীর্ষমানের খতীবদের ব্যবহৃত ভাষায়। তাই কুরআনী ভাষার বচন-সংক্ষেপ এবং অলৌকিকতা অনুধাবন করতে হলে প্রাগৈসলামিক যুগের কবি-সাহিত্যিকদের কাব্য-কবিতার মানগত স্তর এবং দোষগুণ বুঝার রুচিবোধ থাকা জরুরী। কেউ যদি সে যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম না হয়, তাহলে তার পক্ষে বুঝা আদৌ সম্ভব হবে না। কুরআন যে আরবী ভাষার কত বড় পরিশীলিত নমুনা, তার যাদুকরী আকর্ষণ কত যে তীব্র এটাও সে বুঝতে পারবে না। কুরআনের প্রভাব যে কত প্রচন্ড-যার তোড়ে সমকালীন আরব পন্ডিতবর্গের ভাষালংকারগর্বী দাপট চিরদিনের জন্য ধূলায় মিশে গিয়েছিল।
এসব আরবী সাহিত্যের অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও এখন অনেকই প্রকাশিত আকারে পাওয়া যায় খুব সহজেই। কুরআন বুঝতে হলে এগুলো জানা আবশ্যক।

এ আবশ্যকতাকে লেখক বলতে চাচ্ছেন – “আমার কথাটাকে আত্মগর্বী রুপ দিয়ে এ অর্থে নেয়া ঠিক হবে না – নিজের মধ্যে প্রেরণার প্রাচূর্য আছে বলে আমি উচ্চ কন্ঠের দাবীদার। কুরআনী ভাষার ধরণ কি, তার সাহিত্যিক রস-মাধূর্য পরিমাপের তুলাদন্ড কি হওয় উচিৎ? এসব চিহ্নিত করাই আমার মূল প্রতিপাদ্য…এ ব্যাপারে যা কিছু করেছি তাতে আমার তুলনায় মরহুম হামীদুদ্দীন ফারাহীর অবদানই সর্বাধিক।। তাফসীর লিখার প্রয়োজনীয় উপাদান তিনি পূর্বেই চিহ্নিত করে রেখেছিলেন।”

–অর্থাৎ এসব প্রাচীন রিসোর্সগুলোর সিস্টেম্যাটিক আমিন আহসান ইসলাহী (রাহিমাহুল্লাহ) তার উস্তাদ থেকেই পেয়েছিলেন তার গবেষণালব্ধ সম্পদ থেকে। এবং এগুলোকে তিনি ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন তাদাব্বুরে কুরআন লিখার সময়।

“কুরআন কেবল ভাষা ও বর্ণনাভংঙ্গি বিষয়ে নয়, বরং আরবদের দৈনন্দিন জীবন-ধারা, সামাজিক রীতিনীতি, পারস্পারিক লেনদের, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-তমদ্দুন, ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস, রাজনৈতিক চিন্তাধারা, পরিবেশগত চিন্তা-চেতনা, ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণে যাচাইয়ের মাপকাঠি, জীবন চলার গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি সার্বিক বিষয়-আশয় বুঝার ক্ষেত্রে তার সাহিত্যকর্ম থেকে যে নির্দেশনা পাওয়া যায়, অন্য কোথাও থেকে তা পাওয়া যায় না। অথচ কুরআনের ইশারা-ইংঙ্গিত ও ভাব-দর্শন যে ব্যক্তি নিজে বুঝতে চায় এবং অপরকে বুঝানোর আগ্রহ পোষণ করে, তার নিজের উপরোক্ত বিষয়সমূহের অবগতি একান্ত জরুরী।

আল-কুরআনের বৈশিষ্ট এখানেই—আনুষঙ্গিক বিষয়ের আলোচনা পরিহার করে আরব জনগোষ্ঠীর জীবন দর্শন থেকে সে অন্যায়-অকল্যাণের বিষদাঁত নির্মূল করেছে। অপরদিকে তাদের জীবন প্রবাহে কল্যাণের সে বিজ এতদিন সুপ্ত ছিল, সেগুলোকে বিকশিত করেছে। সে কারণে কথার ফাঁকে ফাঁকে বার বার এমন সব ইশারা-ইংঙ্গিতের অবতারণা লক্ষ্য করা যায়, সেগুলোর স্পষ্টকথায় বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে জাহেলী কুসংস্কার শিকড় গেড়েছিল। সাথে সাথে এটাও জানতে হবে – সংস্কারের অস্ত্র দিয়ে ইসলাম কোথায় ও কিরুপে আঘাত হেনেছ।” – উপযুক্ত সকল স্থানেই এর উদাহরণ এসেছে প্রচূর পরিমাণে যার পরিহার কুরআন উপলব্ধির বাহিরে।

ইসলামপূর্ব ইতিহাসের দুপিঠ পাঠের নিরপেক্ষতা নিয়ে তিনি বলেনঃ

আর আমাদের ইতিহাসবেত্তাগণ আরবের যে ইতিহাস বর্ণনা করেছেন সেটা যেন কিছু জংলী হায়েনাদের ইতিহাস। অথচ এখানে প্রশ্ন আসে যে আরবরা যদি এত বন্য প্রাণী হয়ে থাকে তবে কুরআনের ন্যায় আসমানী গ্রন্থের বাহক হয় কীভাবে? সেকারণে ইতিহাস গ্রন্থের চর্চা বাদ দিয়ে জাহেলী আরব সাহিত্যে বর্ণিত আরব সমাজের দোষ-গুণ উভয়দিক অধ্যয়নে আমাকে মনোযোগ দিতে হয়েছে। সে প্রচেষ্টার ফলে আমার জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। যাকে তাফসীরের কাজে আমি পুরোপুরি ব্যবহার করেছি।
“উপরিক্ত বিশ্লেষণের আলোকে স্পষ্টত বুঝা যায়— সীমিত অর্থ পরিহার করে ভাষাগত বিষয়টিকে আমি ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেছি।
আমার মতে কুরআন বুঝা ও চর্চার ক্ষেত্রে সেই ভাষা ও সাহিত্য রসবোধ, অলঙ্কার-মাধূর্য আকর্ষণে দুর্বার মননশক্তিই কার্যকর হাতিয়ার- যে ভাষার আবরণে কুরআন নাযিল হয়েছে। যার মধ্য সে বোধশক্তির কমতি কিংবা শূন্যতা বিরাজমান, তার পখে কুরআনের অলঙ্কার মহিমা, বক্তব্যের চমৎকার উউপস্থাপনা বুঝে ওঠা কঠিন। এমনকি না পারার সম্ভাবনাই ষোলআনা”।
যোগসূত্র ও পারস্পারিক সম্পর্কের অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা

“কালাম তথা কথাবার্তার মধ্যে পারস্পারিক যোগসূত্র অপরিহার্য। যার অবর্তমানে মানসম্মত রচনা বা উক্তির কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু চরম অলঙ্কার সমৃদ্ধ ও নির্মল সাবলীলতার শৈলচূড়ায় অবস্থান সত্ত্বেও কতিপয় লোকের নিকট এহেন অলৌকিক ভাষণমন্ডিত আল-কুরআন যোগসূত্রবিহীন একটি শুণ্যগর্ভ কিতাব। যারা আয়াত ও সূরাসমূহের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক নেই বললেই চলে। ভাবতে অবাক লাগে শত্রু-মিত্র সকলেই অবিসংবাদিত মতে যে গ্রন্থ গোটা বিশ্বকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্ভোদ্ধ করেছে, যার মরমী সুরে জগদ্বাসী মুগ্ধ বিমোহিত, যে গ্রন্থ মহাবিশ্বের চিরস্থায়ী চ্যালেঞ্জ, তার ভাষণ বক্তব্য পরস্পর সম্পর্কহীন ফাঁকা বুলি হয় কিরুপে? যে গ্রন্থ বিশ্বমানবতার চিন্তা-চেতনা নতুন বুনিয়াদে দাঁড় করিয়ে তদুপরি তাকে এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করতে সক্ষম, তার ভাষ্য সূত্রহীন ছাড়াছাড়া-কথাটা বিস্ময়ের ঝাঁকুনি দেয় বৈকি।”

“কুরআনিক ভাষ্যের অন্তরালে যোগসূত্র কিংবা তরতীব(বিন্যাস ধারা) যদি না-ই থাকে, তবে তা যে ক্রমধারায় নাযিল হয়েছে সে বিন্যাস অনুসারে সংকলন করাই সঙ্গত ছিল। কিন্তু সর্বজন বিদিত কথা কুরআনের সংকলন বিন্যাস ধারা অনুসরণ হয়নি। হয়েছে নবী কারীম ﷺ এর নির্দেশে স্বতন্ত্র নিয়মে, যা বর্তমানে আমরা দেখতে পাই। দ্বিতীয়ত সমতার ভিতিতে সংকলনেরও সুযোগ ছিল। অর্থাৎ প্রত্যেক সূরার আয়াত সংখ্যা সমপরিমাণে বিন্যাস করে দেওয়া। অথচ বাস্তবের সাক্ষ্য এর বিপরীত। ছোট-বড় সব ধরণের সূরাই কুরআনে সন্নিবেশিত। কোনো কোনো ছোট সূরাকে আবার বড় সূরার পূর্বে রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে হাফেযদের সুবিধার জন্য অসম সূরা বিভক্তির প্রয়োজন ছিল না। প্রায় পারায় বিন্যাসই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সবাই জানে—সূরা পারার এ ক্রমবিন্যাস, ধারাবাহিক এবং সাজানি নবী করীম ﷺ এর নির্দেশে সম্পন্ন হয়েছে। ব্যক্তি মানুষের করণীয় এখানে কিছুই ছিল না…”।

এসমস্ত কারণে অনেক আলেমগণ পূর্বেও কুরআনের আয়াত কাঠাকমোর গভীরে যোগসূত্রে জড়ানো মযবুত বাঁধন আকার জোরসমর্থন করেন। এমনকি তাদের মাঝে কেউ কেউ বই পর্যন্ত লিখেছিলেন। কিন্তু কেন এটিকে এতদিন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে তার একটুখানি বর্ণনা পাওয়া যায় ইমাম সুয়্যুতি (রাহিমাহুল্লাহ) এর বর্ণনায়ঃ

“নযম ও তারতীব(যোগসূত্র ও বিন্যাস)জ্ঞান বড় উচ্চমানের বিষয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কঠিন ও জটিল হওয়ার দরুন মুফাসসিরগণ সেদিকে অল্পই দৃষ্টি দিয়েছেন।”

ফখরুদ্দিন আল-রাযী(রাহিমাহুল্লাহ)তো বলেছেনঃ

“কুরআন কারীমের জ্ঞান ভান্ডার পারস্পারিক যোগসূত্র ও বিন্যাসের অন্তরালে”

অধিকন্তু ফখরুদ্দিন আল-রাযী (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেনঃ
“যারা বলেন কুরআনের আয়াতগুলো কেবল একের পর এক সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যার মধ্যে পরস্পর কোনো সম্পর্কে নেই। আমার মতে এ ধরণের কথা বলা পবিত্র কুরআনের প্রতি ঘোর অবিচারের নামান্তর। উপরন্তু একথার ভিতর থেকে আপত্তিকর প্রতিবাদের একটা প্রচ্ছন্ন সুরও ভেসে উঠে, যা প্রজ্ঞাময় কুরআনের দিকে গড়ায়। এমতাবস্থায় কুরআনকে অলৌকিক মর্যাদায় আসীন বলা তো দূরের কথা সুবিন্যস্ত একটি গ্রন্থ স্বীকার করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়”।
এবং তিনি একটি পূর্ণ সূরা এরকম যোযসুত্র ও বিন্যাস ধারাবাহিকতা বর্ণনা করে এর প্রামাণিক জবাব দেন।

আমিন আহসান ইসলাহী(রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ

যারা যোগসূত্র ‘নেই’ বলতে আগ্রহী, এ অস্বীকৃতির পথে তারা কোনো প্রমাণের ভিত্তিতে অগ্রসর হয়েছেন কিংবা যোগসূত্রহীনতাকেই তারা কালামুল্লাহর মহিমা ও চমৎকারিত্বে বিশ্বাসী—একথা বলারও কোনো সুযোগ নেই। বরং পারস্পারিক যোগসূত্রের অভাব তারা অনুভব করেছে অথচ সমাধান তাদের জানা নেই। এমতাবস্থায় দূর্বল যতই হোক উপায় অবলম্বন একটা পাওয়া গেলেই হলো। তার ছায়ায় আশ্রয় নিতে কার্পণ্য করেনি।

এমতাবস্থায় কুরআনকে অভিযুক্ত না করে সকল ক্রটি নিজেদের উপর চাপিয়ে নিলেই তারা আন্তরিকতা ও ন্যায়নীতির অনুসারী বিবেচিত হতেন। আর দ্বিতীয়ত যারা কুরআনে যোগসূত্র থাকার সমর্থক, তাদের খেদমতের যথার্থ মূ্ল্যায়ন স্বীকার করা সত্বেও না বলে উপায় থাকে না – এ অঙ্গনে প্রমাণ সিদ্ধ এমন কোনো অবদান রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি (জটিলতা নিরসনে ও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে)।

এক্ষেত্রে মাওলানা হামীদুদ্দীন ফারাহী(রাহিমাহুল্লাহ)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি জোরালো যুক্তি ও গ্রহণযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে বিষয়টিকে প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। কিছু সূরার এভাবে শেষও করেছিলেন তাফসীররুপে কিন্তু পূর্ণাংগ তাফসীর সংকলন করতে পারেন নি তার ওফাতের কারণে।
ফারাহীর এ বিষয়ে লেখা পান্ডুলিপি পড়লে দুটি বিষয় অবশ্যই স্বীকার করতে হবে

১। কুরআনের মধ্যে যোগসূত্রের অবস্থান অস্বীকার করা মস্ত বড় যুলুম।
২। কুরআনের হেকমত ও জ্ঞানভান্ডার মূলত এর যোগসূত্রের অন্তরালে নিহিত।

তিনি আরও বলেছেন :
“একজন মিলিটারি সেনানায়ক সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে যা প্রজ্ঞার নির্দেশ করে। একমাত্র মিলিটারি ক্ষেত্রে দক্ষ লোকই এরকম সাজানোর পেছনের কৌশলগত প্রজ্ঞা উপলব্ধি করতে পারে।
সাধারণ জনগণ এরকম সাজানোর ব্যবহারিক দিকের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে কেবল তখনই যখন সেনাবাহিনী বিজয় অর্জন করে। তেমনি কুরআনে একটি বিষয়বস্তু (Theme) কে বিভিন্ন স্টাইলে বহুবিদ পদ্ধতিতে প্রকাশ করেছে। কেবল শৈল্পিকজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিই একরকম শৈল্পিক ধারায় বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহারের পেছনের সৌন্দর্য ও প্রজ্ঞা এবং নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ব্যবহারিক উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারে”।