বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম
ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংঘাতময়
বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতার যে প্রশ্ন হাজির হয়েছে তার
প্রেক্ষিতে যেসব ইসলামী বোদ্ধারা পথ দেখিয়েছেন, যাদের চিন্তনপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অন্ধকারের যাত্রীরা আলোর
পথের দিকে ধাবিত হতো, যারা
রাসূলের(সা)এর উত্তরাধিকার হিসেবে ইসলামী শরীয়ার পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থাকে
পরিস্থিতির আলোকে সমস্যার সমাধানকল্পে পাশ্চাত্য ও তাগুতের বিপরীতে নবরুপে
আধ্যাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামের পূণর্জাগরণ ঘটিয়েছে, সমাজের প্রত্যেকটি জায়গায় যুগের চাহিদার আলোকে ইসলামের
সমাধান তুলে ধরে ইসলামের চিরন্তন ও বৈশ্বিক রুপ দেখিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে আল্লাহর
বাণীকে সমুন্নত রাখার তীব্র প্রচেষ্টায় ব্রত ছিলেন, তাদের আলোকিত জীবনের অবদানের মাঝে রয়েছে আমাদের আজকের
সমস্যার সমাধানের বীজ।
পবিত্র কোরআনে অতীত জাতিসমূহের
উদাহরণ কেন টানা হয়েছে জানেন?এক কথায় শিক্ষা বা হেদায়েত নেওয়ার জন্য। এই
হেদায়েত কেবল একটি শব্দ ‘হেদায়েত’ শব্দের মাঝে নিহিত নয়। অতীতের জাতির ভুলগুলোকে
শুধরে নেওয়া, তাদের বিফলতার চিত্রকে পর্যালোচনা করে সফলতার প্ল্যান করা। আমাদের
ইসলামী সংগঠনগুলোতে অনেক ভুল রয়ে যায়, সেই ভুলগুলোকে না শুধরে যখন আমরা এর বিপরীতে
কোন অপকৃতিস্ত অবস্থা চলে আসে তখন সেগুলোকে আমাদের অজ্ঞতা দিয়ে ঢেকে ‘পরীক্ষা’ বলে
চালিয়ে দেই!! আমাদের জ্ঞান নেই সেটা না দেখে বরং আমাদের অজ্ঞতা দিয়ে অসেচতনতাকে
ঢাকার বিফল চেষ্টা! অথচ উচিৎ ছিল অতীতের ইসলামী বোদ্ধারা ইসলামের যেই চিরন্তত
ধারাকে বজায় রেখে মৌল উদ্দেশকে বাস্তবায়নের পথে কাজ করে গেছেন, তাদের সেই কাজের ধারাকে
নব উদ্দ্যমে নবরুপে আমাদের সমাজের নতুন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিবেচনায় এনে কাজ
করা। এসব ইসলামী বোদ্ধাদের জীবনীর উথান-পতনের ইতিহাস আপনাকে আজকের দিনের সমস্যাকে
মোকাবিলা করার পথ দেখাবে।
আপনি বা আমি যখন ইসলাম নিয়ে কাজ
করতে যাবো ভাবি, তখন কোন কাজটি করবো, কোনটি সর্বাপেক্ষা বেশি প্রয়োজনীয়, কোনটিতে
জাতি বেশি উপকৃত হবে, মেজর ও মাইনর ইস্যু কোনগুলো, সর্বাপেক্ষা ফোকাসের জায়গা কী
কী হওয়া উচিত...এগুলো করতেই হাফিপে পড়ি। অথচ আমাদের ভাবা উচিৎ ছিল আমাদের পূর্বে
যেসব ইসলামের কর্মী চলে গেছেন তাদের প্রত্যকের বিশাল চিন্তা ছিল, কর্মের বিশাল
অবদান। এসব অনেক অবদান রয়ে গেছে অগোচরে। অথচ জাতির সেগুলোই প্রয়োজন ছিল বেশি। ১০০
জন ইসলামী চিন্তাবিদের জীবনী পড়লে হয়তো ৫০০টি চিন্তা পাবেন, যেখানে আপনি সঠিকভাবে
একটিই ভাবতে পারছেন না, দাড় করাতে পারছেন না আপনার চিন্তার রুপরেখা। এসব
চিন্তাশীলদের জীবনী আপনাকে আইডিয়া দেবে...বিকশিত করবে আমাদের চিন্তার রুপরেখা,
উন্নত করবে আমাদের কর্মপরিকল্পনা-যেন চিন্তাহীনতা থেকে নিয়ে যাবে পরিপক্ক চিন্তার রুপরেখা
ও বাস্তবিক কর্মপরিকল্পনা দিকে।
বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তার
জগতের মানুষেরা যারা সমকালের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকেন
তারাই সমাজ পরিবর্তনের মত ঐতিহাসিক ও বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেন। সক্রেটিস তার
যুগে এথেন্সবাসীর প্রতিষ্ঠিত চিন্তা-ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। কনফুসিয়াস
যুদ্ধরত চৈনিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসের কথা
বলেছিলেন। মার্টিন লুথার তার বিপ্লবী চিন্তাভাবনা দিয়ে পুরো পশ্চিমের খ্রিষ্টীয়
সমাজ কে পাল্টে দেন এবং লেলিন তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক কর্মষণা দিয়ে বিশ
শতকের গতি অনেকটা পালটে ফেলেন।
উনিশ ও বিশ শতকে মুসলিম সমাজের ভেতরেও এ রকম কিছু বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাশীল ব্যক্তি আবির্ভূত হন যারা গতানুগতিক ব্যবস্থাকে রূপান্তর করতে উদ্যোগী হন। সমকালীন মানসিকতা ও নানা রকম প্রতিষ্ঠানকে সমালোচনা করেন। বিকল্প চিন্তার স্ফুরনের পাশাপাশি বিকল্প পথ ও পদ্ধতির নির্দেশ করেন। আজকের মুসলিম দুনিয়ায় ইসলামি রেঁনেসা বা পুনর্জাগরণবাদের যে ঢেঊ প্রবাহিত হচ্ছে তার পেছনে এ সকল মুসলিম বুদ্ধিজীবী, তাত্ত্বিক ও সমাজ বিপ্লবীদের অবদানই সর্বাধিক।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা এ
সকল বুদ্ধিজীবী, তাত্ত্বিক ও সমাজ বিপ্লবীদের বাঙ্গালী পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং
তাদের নিকট থেকে বাঙালী মুসলমান সমাজ যেন সঠিক পথ নির্দেশনা ও উদ্দীপনা গ্রহণ করতে
পারে এ জন্য বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ফাহমিদ-উর-রহমান তাঁর কলম হাতে এগিয়ে
এসেছেন। একশ’ জন মনীষীর জীবনালেখ্য ছাপার অক্ষরে লিখার দায়িত্ব তিনি নিজ কাঁধে
স্বেচ্ছায় সাবলীলভাবে তুলে নিয়েছেন। প্রতি খন্ডে ২৫ জন মনীষীর জীবনালেখ্য তুলে
ধরার পরিকল্পনা করে চার খন্ডের প্রথম খন্ড তিনি প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন । সে
বইটি নিয়েই আজকে আমাদের বই পরিচিতি পর্ব।
যে পচিশ জনের অজানা তথ্য তিনি এ খন্ডে তুলে ধরেছেন তাঁরা হলেনঃ
১. জামাল উদ্দীন আফগানী (জন্ম ১৮৩৯)
২. মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (জন্ম ১৮৬৮)
৩. মাওলানা ইউসুফ আলী (জন্ম ১৮৭২)
৪. মোহাম্মদ মারমাডিঊক পিকথল (জন্ম ১৮৭৫)
৫. মোহাম্মদ ইকবাল (জন্ম ১৮৭৭)
৬. মোহাম্মদ আসাদ (জন্ম ১৯০০)
৭. রুহুল্লাহ খোমেনী (জন্ম ১৯০২)
৮. সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (জন্ম ১৯০৩)
৯. আবুল হাসিম (জন্ম ১৯০৫)
১০. মালেক বেন্নাবী (জন্ম ১৯০৫)
১১. হাসান আল বান্না (জন্ম ১৯০৬)
১২. সাইয়েদ কুতুব (জন্ম ১৯০৬)
১৩. মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ (জন্ম ১৯০৮)
১৪. মার্টিন লিংস (জন্ম ১৯০৯)
১৫. ইসমাইল রাজী আল ফারূকী (জন্ম ১৯২১)
১৬. সৈয়দ আলী আশরাফ (জন্ম ১৯২৪)
১৭. আলীয়া আলী ইজেতবেগভিচ (জন্ম ১৯২৫)
১৮. হাসান জামান (জন্ম ১৯২৮)
১৯. মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান (জন্ম ১৯৩১)
২০. খুরশীদ আহমেদ (জন্ম ১৯৩২)
২১. হাসান আল তুরাবী (জন্ম ১৯৩২)
২২. আলী শরিয়তী (জন্ম ১৯৩৩)
২৩. মরিয়ম জামিলা (জন্ম ১৯৩৪)
২৪. রশিদ আল ঘানূশী (জন্ম ১৯৪১)
২৫. আকবর এস আহমদ (জন্ম ১৯৪৩)যে সকল মনোষীদের জীবনালেখ্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে তারা সবাই গত শতাব্দীর বিশ্বব্যাপী ইসলামি আন্দোলনের সিপাহশালার, কান্ডারী, তাত্ত্বিক চিন্তাবিদ ও সমাজ সংগঠক। এখানে শুধু তাদের জীবনপঞ্জিই তুলে আনা হয়নি বরং তাদের কৃত কর্ম, লিখিত বই এবং সমাজ-সংগঠনের এক স্বচ্ছ, সংক্ষিপ্ত অথচ পরিপূর্ণ চিত্রও তুলে আনা হয়েছে।কাজেই বইটি শুধু তাত্ত্বিক, চিন্তাবিদ ও সংগঠকদের জীবনালেখ্যই হয়ে থাকেনি বরং তা হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী ইসলামি পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলন, সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলন, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের এক চমৎকার ইতিবৃত্ত।
যেহেতু আলোচিত এ বিদগ্ধ এ পন্ডিতরা দুনিয়ার
বিভিন্ন স্থানে জন্ম গ্রহণ করেছেন এবং আপন আপন জায়গা ও কর্মক্ষেত্র থেকে ইসলাম
অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন, কাজেই বইটি
একটি আন্তর্জাতিক চরিত্র অর্জন করেছে। মুসলিম ধর্মানুসারী নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবার উপযোগী বইটি।
ইসলামি বোদ্ধা, অনুঘটক ও পরিবর্তনশীল মনন, চিন্তার প্রখরতা-বিশালতা, ইসলামী কর্মের বিস্তৃতি ও পলিসি-প্ল্যান স্ট্রাটেজির জন্য...আমি স্ট্রংলি
বিশ্বাস করি প্রত্যেকের জন্য এই বইটা পড়া দরকার।
বইয়ের লেখক ফাহমিদ-উর-রহমান কে নতুন করে পাঠক
সমাজে চিনিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তিনি নিজ গুণে ও মানেই সুপরিচিত। পেশাগত জীবনের
পাশাপাশি তিনি দু’ হাতে লিখে চলেছেন অবিরত। তিনি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন সাংস্কৃতিক
আত্ম-পরিচয় ও বৈশ্বিকভাবে বাঙ্গালী মুসলমানের স্থান নির্ণয়ের কাজে। এ তাঁর
নিতান্তই স্বজাতিপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম, ধর্মপ্রেম এবং দায়িত্বশীলতারই বহিঃপ্রকাশ।
তাঁর লিখিত অনেক বইয়ের মধ্যে অসাধারণ কয়েকটি বই হচ্ছে (১) উত্তর আধুনিকতা, (২) সাম্রাজ্যবাদ এবং (৩) ইকবাল মননে
অন্বেষণে।
এছাড়া তাঁর সম্পাদিত জীবনীমূলক একটি প্রখ্যাত প্রকাশনা হচ্ছে- জামাল উদ্দীন
আফগানী।
সমাপ্ত
পরিচালকঃ বাংলা সাহিত্য পরিষদ। রেইলগেট, বড় মগবাজার,
প্রথম প্রকাশঃ এপ্রিল, ২০১০।
পৃষ্ঠা সংখ্যা-৩৬০