দুটি প্রশ্নাকারে অভিযোগ ও প্রতিউত্তর
নযম বা যোগসূত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে যারা সঠিক ধারণা পোষণ করে না, তারা বলেনঃ১। কুরআনে যদি যোগসূত্র থেকেই থাকে তা সুক্ষ্ণ ও তত্বীয় এবং এর উপর কুরআনের বুঝ বা উপলব্ধিহীনতা নির্ভর করে না।
২। যদি নযম(সাজানো যোগসূত্র)থেকেই থাকে তবে এর সন্ধান পেতে এত বছর লাগল কেন? বা কতিপয় লোকের কাছেই কেন তা ধরা দিল? অন্যান্ন এত আলেমদের নিকট কেন এটা উপস্থিত হলো না বা বোধগম্যতায় আসলো না?
প্রথম অভিযোগের উত্তর
যোগসূত্রের মর্যাদা ও মূল্যমান
“কুরআনের মূল উদ্দেশ্য ও ভাবের সাথে যোগসূত্রেরর নিবিড় কোনো সম্পর্ক নেই মনে করা এবং ভাবের দৃষ্টিকোণ থেকে এর মর্যাদা ও মূল্যবান অস্বীকার করত একে নিছক জ্ঞানগত সুক্ষ্ণ তত্ত্বের দিশারী সাব্যস্ত করা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত্রিকর কথা। আমরা তো এর মূল্যমান এভাবে নির্ধারণ করে থাকি যে, কুরাআনী হেকমত ও জ্ঞান ভান্ডারে পৌছতে হলে একমাত্র এর মাধ্যমেই সম্ভব। তাই আমাদের মতে যোগসূত্রের নির্দেশনা ছাড়া কুরআন অধ্যয়নকারী ব্যক্তি বড়জোর বিচ্ছিন্ন কতিপয় বিধিবিধান আর আলগা ধরণের কিছু হেদায়েত লাভে সক্ষম হতে পারে—এর বেশি কিছু নয়। অবশ্য আল-কুরআনের ন্যায় একটি মহাগ্রন্থের ছিন্নই হোক আর আলগা যে কোনো হুকুম-হেদায়েত লাভ করতে পারা কম কথা নয়। তবে পারিবারিক চিকিৎসার বই পড়ে কয়েকটা জটিবটির দ্রব্যগুণ জেনে নেওয়া আর বিজ্ঞ চিকিৎসক সেটাকে রাসায়নিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জীবন রক্ষাকারী ঐষধে রুপান্তরিত করার মধ্যে আকাশ পাতালের পার্থক্য ব্যবধান…আরবী ভাষা-ব্যাকরণ ও বাকরীতি অনুসারেই কুরআনের শব্দ ও বাক্য সমষ্টি গঠিত, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু আসমানী বিন্যাসধারা একে যে পূর্ণতা ও ভাব মাধুর্যের শৈলচূড়ায় আসীন করেছে, জগতের কোনো জিনিস তার মোকাবিলা করতে পারে না।”“ইসলামের শাশ্বত মূল্যবোধ ও দ্বীনের হেকমত যে ব্যক্তি জানতে আগ্রহী, ভাল-মন্দ, সত্য-অসতের পার্থক্য, গুণগত পরিচয় এবং পর্যায়ক্রমিক গতিধারা অবশ্যই জানতে হবে। নতুবা যক্ষা রোগের আলামতকে সর্দী জ্বরের লক্ষণ আর সর্দীর উপসর্গ দেখা দিলে ক্ষয়রোগের আগমনী বার্তা সাব্যস্ত করে বসা তার পক্ষে বিচিত্র নয়। এমনকি আশংকা প্রবল বলাই সমীচীন। কুরআনের এ তত্ত্বকথা কালামের অংশ দ্বারা নয়, পূর্বাপর মিলিয়ে পূর্ণ বিষয়বস্তুর আলোকেই বরং স্পষ্ট হতে পারে। কেউ যদি একটি সূরার আয়াতসমূহের পারস্পারিক তত্ত্বপূর্ণ যোগসূত্র বিষয়ে অবগতি লাভ করতে সমর্থ না হয়, তাহলে কেবল পৃথক পৃথক আয়াতের অনুশীলন দ্বারা যে জ্ঞান আদৌ আসতে পারে না ”\
পক্ষান্তরে তারতীব তথা বিন্যাসধারা সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তি খন্ড বিষয়ে একটা আবছা ও অস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে বটে, কিন্তু সূরায় বর্ণিত হেকমত ও তত্ত্বজ্ঞানের পরশ থেকে তাকে পুরোপুরি বঞ্চিতই থাকতে হবে। এটা হলো আলোচ্য বিষয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও একটা বাঞ্চিত দিক…”।
“মুসলিম জাতির ঐক্য আল্লাহর রশি দিয়ে বাঁধা, কথাটা সকলের জানা। বলা হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে নয়, আল্লাহর রশিকে তোমরা শক্ত হাতে ধর এবং সম্মিলিতভাবে। অতএব আমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হলে আসমানী গ্রন্থ আল-কুরাআনের ফায়সালাকে চূড়ান্ত সমাধানরুপে মেনে নেওয়াটাই এ আদেশের স্বাভাবিক চাহিদা। কিন্তু দূর্ভাগ্য বলতে হয়—যে কুরআনের নির্দেশ মেনে চলা আমাদের ঈমানের দাবী, স্বয়ং সে কুরআন সম্পর্কেই আমরা ঐক্যমত্যের প্রমাণ দিতে সক্ষম হই না। একই আয়াতের শত ব্যাখ্যা শত মত। যা বিপরীত অর্থ বহন করে ভিন্ন পথে ছুটে। অথচ নিজেদের কাছে এমন কোনো জিনিসও নেই যদ্বারা সঠিক-সত্যে মতটি বেছে নেয়া যায়। কোনো কথার ব্যাখ্যায় মতানৈক্য দেখা দিলে তার পূর্বাপর সম্পর্ক এবং আনুষঙ্গিক পরিবেশ পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই হলো তা দূর করার সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য উপায়। কিন্তু কুরআনের ব্যাপারে সর্বনাশা বিপদ হলো, এর মধ্যে যে পূর্বাপর সম্পর্ক ও গভীর যোগসূত্র জড়িয়ে আছে সে কথাটা লোকেরা স্বীকারই করে না। ফলে দূর্গতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের সমাজে সৃষ্ট মতবিরোধগুলোর সুরাহা তো হয়ইনি, বরং এর প্রত্যেকটি নিজস্ব ধারায় শক্তি সঞ্চয় করে স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। আমাদের ফেকাহ শাস্ত্রীয় বহু মতবিরোধ শুধু পূর্বাপর সম্পর্ক ও অন্তর্নিহিত যোগসূত্রের তলিয়ে না দেখার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। আগে-পিছের ও যোগসূত্র বিবেচনা করা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে একের অধিক দ্বিতীয় মতের কোনো অবকাশই পাওয়া যায় না।”
“ফেকাহর মতানৈক্য যতটুকু ক্ষতিকর তার চেয়েও মারাত্বক ও ভয়াবহ ক্ষতি করেছে আমাদের সমাজের বেদাতী ফের্কাগুলো। যার যার সমর্থনে দলীল হিসেবে এদের অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছে কুরআন কারীমকে। পূর্বাপর সম্পর্ক ছিন্ন করে আয়াতের ভিতর মনগড়া অর্থ ঢুকিয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, আপন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার কৌশল এরা উত্তমরুপে কাজে লাগিয়েছেন। ব্যস- শব্দ এখন শুণ্য ঘরে এসে গেল। এবার তাকে নিজস্ব অর্থের পোশাকে সাজাও, বানোয়াট মর্মের লেই দিয়ে মেরামত কর, সবই সহজ—সবই কুরআন। ঠেকায় কে? এভাবে শব্দের খোলসে এমন অর্থ ঢোকানো যায়, স্বয়ং বক্তা যার কল্পনা-ই করেনি…অপরদিকে কোন পরিবেশে আয়াত নাযিল হয়েছে, কোন পরিস্থিতি কি ছিল এবং এর সাথে পূর্বাপর সম্পর্কই বা কি? এসব কথা তলিয়ে দেখার ভাগ্য কারো হয় না। মোটকথা তাদের মতে কুরআনী আয়াতের গভীরে পারস্পারিক সম্পর্ক, পূর্বাপর যোগসূত্র, নাযিল হওয়াকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি ইত্যাদি আনুষঙ্গিক অথচ অনিবার্য বিষয়গুলোর কোনো গুরুত্ব আছে বলে আদৌ মনে হয় না। এ বিষয়ে তারা মাথা ঘামাতেও রাজি নয়।”
“আলোচ্য তাফসীর গ্রন্থে যোগসূত্র ও পারস্পারিক সম্পর্ক বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বিধায় আগাগোড়া সর্বত্র আমি একই মত অনুসরণ করেছি। অন্য কথায় অভিন্ন ও একক মত অনুসরণে আমি বাধ্য হয়েছি। কারণ আমার মতে যোগসূত্রকে অপরিহার্য বিষয় ও অনিবার্য দিশারী স্বীকার করত লক্ষ্যপানে অগ্রসর হলে মতবিরোধের তেপান্তরে চক্কর খাওয়ার প্রশ্নই থাকে না। কোনো সহীহ-শুদ্ধ বিষয়টি তখন জীবন্ত আকারে সামনে এমনভাবে উপস্থাপিত হয়—কেউ যদি একেবারে অন্ধ, বোবা কিংবা পক্ষপাতিত্ব রোগে আক্রান্ত না হয়, তবে সে জীবন দিতে পারে, কিন্তু তাকে পরিত্যাগ এমনকি সামান্য উপেক্ষার নযরে দেখাও তার পক্ষে সম্ভব হতে পারে না”।
যোগসূত্র বাক্যে অর্থ যোগ করে এবং আল্লাহর চূড়ান্ত ইচ্ছাকে নির্দেশ করে
মাওলানা ফারাহী (রাহিমাহুল্লাহ) হযরত আবু বুকর(রাজিয়াল্লাহু আনহু) এর উদাহরণ এনেছেন। যে ব্যক্তি সালাত আদায় করত কিন্তু জাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল। ওমর(রাজিয়াল্লাহু আনহু) বলেছিলেন আপনি কেমন করে তাকে কুফুরিতে ফেলছেন অথচ সে ‘লা ই লাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে ও সালাত আদায় করে। আবু বকর(রাজিয়াল্লাহু আনহু) কি বলেছিলেন?…যে ব্যক্তি সালাত এবং জাকাতের মাঝে পার্থক্য করে…।
কেন বলেছিলেন এই কথা? যারা মুসলিম কমিউনিটির মাঝে রয়েছে তারা যদি সালাত আদায় না করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কুরআনে যেহেতু সালাত আদায়ের সাথে জাকাতের কথা এসেছে একই সাথে, তাই যারা জাকাত দেবে না তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করা যাবে। কারণ পবিত্র কুরআনে সালাত এবং জাকাত একই সাথে একই ধারাবাহিকতায় এসেছে ৮০বারেরও উপরে। বিচ্ছিন্নভাবে নিলে একে অপ্রাসংগিকভাবে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারবেন কিন্তু আবু বকর(রাজিয়াল্লাহু আনহু) দেখিয়েদিলেন আল্লাহর কালামের ধারাবাহিকতার ব্যবহারেই প্রজ্ঞা এবং এই ধারাবাহিকতা না নিলে বিশৃংখলা হবেই।
আর জাকাতকে রিবা বা সুদের বিপরীত করা হয়েছে। তাই যেহেতু আল্লাহ রিবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন আর এভাবে যাকাত না দিলেও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন- তবে এতদিন গোপন ছিল কেন?
ভাব ও ভাষার সাথে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। যেহেতু এসবই তাদের একান্ত জানা শোনা ব্যাপার। যে কারণে কুরআনের অতি সুক্ষ্ণ ও তত্ত্বপূর্ণ ইশারা-ইংঙ্গিতের মর্ম উদ্ধার করতে তাদের বেগ পাওয়ার প্রশ্ন ছিল অবান্তর। কোনো আয়াত নাযিল হলো—অমনি তার ইশারা-ইংঙ্গিত, নাড়ী নক্ষত্র তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। এমনকি আয়াতের ভাব-দর্শন লুফে নিতে তাদের জটিলতা আর অসুবিধা নামের কোনো জঞ্জালের ছায়া মাড়াতে হয়নি…কিন্তু আমাদের অবস্থা সর্বদিক থেকে ভিন্নতর। ভাষা আমাদের অপরিচিত, পরিবেশ-পরিস্থিতি আমরা জানি না, নিত্যদিনের সমস্যার সাথে আমরা জড়িত নই। আর সময়ের হিসেবে তো আমরা দেড় হাজার বছরের ব্যবধানে।
আর আমাদের অধিকাংশ আলেম, যারা তাফসীর লিখেছেন বা ইসলামেরব ব্যাখ্যা করেছেন তারাও কিন্তু প্রাচীন আরবী সাহিত্য পড়েছেন। কিন্তু তারা যেহেতু জীবন্তরুপে সে সমাজে, সেই পরিস্থিতিতে, সেই দর্শনের সাথে মিশে ছিল না, তাই তাদের পড়ালেখা আর জীবন্তরুপে সেই দর্শনের মাঝে বসবাস করার মাঝে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। তাই আমাদের পরবর্তী আলেমরা তাদের সাহিত্য পড়েও কুরআনে এদিকটা উপলব্ধি করতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত – কোনো বিষয়ে আংশিক এবং সমষ্টিগত জ্ঞানের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েহে। খন্ডিত অংশের জ্ঞান লাভ করা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু দীর্ঘ সাধনা ছাড়া সমষ্টিকে জানা সম্ভব হতে পারে না। বাক্যটা কিরুপে বিন্যাস করা হয়েছে। পরস্পর সাজানো শব্দগুলো কার সাথে কি সম্পর্ক? সে বিষয়ে জানাটাই যোগসূত্রের মূল কথা। অবশ্য অমুক আয়াতের সাথে অমুক আয়াতের সম্পর্ক—কেবল এতটুকু নির্দেশ করাই মূল উদ্দেশ্য নয়। কার্যত যোগসূত্রের উদ্দেশ্য হলো — দ্বীন ও আখলাক-চরিত্রের অংশগুলোর মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক চিহ্নিত করা। উদ্দেশ্য হিসেবে যার মর্যাদা অতি উচ্চে এবং কুরআনের হেকমত বা তত্ত্ব ও দর্শন মূলত এটাই আর হেকমত একটি গোপন ভান্ডার। যার সন্ধান পেতে অক্লান্ত সাধনা ও বিরাট ত্যাগ-তিতিক্ষার আশ্রয় নিতে হয়।
তৃতীয়ত – কুরআন বিজড়িত আরবী ভাষার এমন কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে, একান্তভাবে কেবল তারই। অন্য কোথাও সংশ্লিষ্টতা নেই বললেই চলে। নিজের দাবী প্রমাণ করার জন্য যে পরিমাণ শব্দের প্রয়োজন-ততগুলো শব্দের সাহায্য নেয়া এবং সে পরিমাণ শব্দ প্রয়োগ করাই উচ্চতর অলংকারমন্ডিত আরবী ভাষার নিয়ম। সীমা অতিক্রম করে কেউ যদি অতিরিক্ত শব্দ প্রয়োগ করে এবং কথা বাড়িয়ে বলে তাহলে আরবী শাস্ত্রের অলংকার শাস্ত্রীয় বিধান মতে এটা দূষণীয়। এটাকে বক্তার অক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়। আরবের অধিবাসীরা জন্মগতভাবে প্রখর ও তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির অধিকারী ছিল। তাই আপন বুদ্ধিমত্তা বলে শ্রোতা বুঝে নিতে পারত অথবা বুঝে নেয়া উচিত, এমন সব শব্দগুচ্ছ কালামের ভেতর থেকে বিলোপ করে দেওয়া ছিল তাদের বাকরীতির অন্তর্ভূক্ত…।
আরবদের বাকরীতির একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমরা একটি কথা বলার পর তার স্বপক্ষে দলীল, প্রমাণ, উপমা, ফলাফল, সম্পূরক অথবা অন্য কোন দিক উল্লেখ করতে চাইলে পূর্বাপর উভয় কথার মধ্যকার যোগসূত্র আলোচনা করি কথাটাকে স্পষ্ট করার জন্য। এজন্য আমাদের ভাষায় একাধিক নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আরবদের ব্যবহার স্বতন্ত্র ধরণের। যোগসূত্র ও মাধ্যমের পূনরুল্লেখ পরিহার করে এক্ষেত্রে তারা শ্রোতার বুদ্ধিমত্তা ও স্মরণশক্তির উপর নির্ভর করে। তাদের কথা হলো আমার যতটুকু বলার আমি বলেছি, বাকীটুকু সে পূর্ণ করে নিক। আরবদের নজরে এটাই পান্ডিত্য, এরি মাঝে ভাষার অলংকার নিহিত। কিন্তু যোগসূত্রের এ বিলুপ্তিটাই আমাদের বাগধারায় ব্যবহারিক জটিলতা আনে। যার ফলে আমাদের বুঝতে অসুবিধা কিন্তু তাদের কাছে এর প্রাজ্ঞতা ধরা পড়ত একে একাডেমিকভাবে না এনেও। কারণ এদিকটা তাদের উচ্চতর আলংকারিক ও স্বাভাবিক ভাষার ব্যবহারেই ছিল।
চতুর্থত – কুরআন মহান আল্লাহ তাআয়ালার কালাম সুবাধে পূর্বাপর সমস্ত জ্ঞান তাতে সন্নিবেশিত রয়েছে। বিগত চৌদ্দশত বছরের ন্যায় কেয়ামত পর্যন্ত বিশ্বমানবকে সে পথ দেখার, সত্যের সন্ধানে ধন্য করবে। জ্ঞানের সে সাগর, মা’রেফাতের যে খনি তাতে লুকিয়ে আছে সারা দুনিয়ার মানুষ নিজ নিজ পাত্র ভরে আহরণ করলেও এর ভান্ডার শেষ হবে না। পবিত্র কুরআন পঠন-পাঠন সরল হলেও এর ভেতরে যোগসূত্র ও শব্দের অন্তরালে যে গোপন ভান্ডার রয়েছে তা সাধারণ পাঠে ধরা পড়ে না। এর জন্য দরকার গভীর চিন্তা, সংগ্রাম।
আল-কুরআনের সার্বিক যোগসূত্র ও পারস্পারিক সম্পর্ক
২। প্রতিটি সূরার যেরুপ একটি করে বিষয়বস্তু রয়েছে, একটি করে ভাষণ হওয়ার কারণে। তদ্রুপ সম্পূর্ণ কুরআনেরও কয়েকটি বিষয়বস্তু রয়েছে যাদেরকে ঘিরে পূর্ণ কুরআন আবর্তিত হচ্ছে। এভাবে সম্পূর্ণ কুরআনের প্রত্যেকটি সূরা যেরুপ একটি করে বিষয়বস্তু রয়েছে এবং এ হিসেবে ১১৩টি বিষয়বস্তু রয়েছে(সূরা ফাতিহাতে পূর্ণ কুরআনের বিষয়বস্তু হিসেবে আলাদা)। এবং সব সূরার সকল বিষয়বস্তু মিলে বড় বড় ৭টি গুচ্ছে বিভক্ত। এভাবে মোট সাতটি বড় গ্রুপ রয়েছে পূর্ণ কুরআনে। এ যেন একটি বিল্ডিং এর ৭টি বড় বড় ভিত্তিস্বরুপ পিলার এবং এ মূল পিলারগুলোর প্রত্যেকটির উপর দাঁড়িয়ে আছে একেক গুচ্ছ ছোট্ট ছোট্ট অন্যান্য থাম যা দিয়ে পূর্ণ বিল্ডিং তৈরি হয়েছে।
৩। প্রতিটি সূরা তার পূর্বের এবং পরের সূরার সাথে সংযোগ রয়েছে এবং এভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে পূর্ণ কুরআন জুড়েই।
৪। একটি সূরার আয়াতগুলো পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত এবং এর ধারাবাহিকতা আছে। সুতরাং ধারাবাহিকতা অনুসারে অর্থ না নিলে প্রাসঙ্গিকতা, অর্থের বিশুদ্ধ প্রয়োগ এবং কুরআনের গভীরতর হিকমাহর অপপ্রয়োগ ঘটে এবং কুরআনের মৌলিকত্বই হারিয়ে যায়।
৫। প্রত্যকেটি সূরা যেভাবে ১১৪টি একের পর আরেক ঠিক যেই ধারাবাহিকতায় রয়েছে, এই ধারাবাহিকতা রয়েছে তাদের বিষয়বস্তু ও বড় বড় মূল বিষয়বস্তুর আলোকে। অর্থাৎ
I. ১১৪টি সূরা। প্রত্যেকটি সূরার রয়েছে একটি করে বিষয়বস্তু এবং এভাবে ১১৪টি বিষয়বস্তু।
II. সমস্ত সুরাগুলো আবার বড় বড় বিষয়বস্তুর অধীনে ৭টি ভাগে বিভক্ত। ১১৪টি বিষয়বস্তু যেন ৭টি বড় বিভাবে অধীনে বিভক্ত। এ যেন ৭টি মৌলিক অধ্যায়ের ভেতরে ১১৪টি অনুচ্ছেদ।
III. যেই সাজানি বর্তমান কুরআন রয়েছে—সেই সাজানির ধারাবাহিকতা অনুসারেই বিষয়বস্তুগুলো সাজানো(সামনের চার্ট দ্রষ্টব্য)।
এই ধারাবাহিকতা এবং যোগসূত্র রয়েছে প্রাসঙ্গিকতা, অর্থগত, প্রায়োগিক–সব দিক থেকেই। এবং ধারাবাহিকতা ও পারস্পারিক সম্পর্ক জানা প্রজ্ঞা উপলব্ধির জন্য খুবই জরুরী।
৬। প্রত্যেকটি সূরার পারস্পারিক সম্পর্ক ও নীতিগত আলোচনা স্থান পেয়েছে যাতে প্রত্যকেটি সূরাকে গভীরভাবে এর সমস্ত আয়াতগুলো থেকেই নেওয়া যায়।
৭। প্রত্যেকটি গ্রুপের প্রথম সূরা বা সূরাগুলো মাক্কী আর পরের সূরাগুলো মাদানী। আল্লাহর এ সাজানোর কারণ হলো মাক্কী যুগে কোন শরীয়া আইন ছিলো না কিন্তু মাদানী যুগে শরীয়া আইন আসে। অর্থাৎ মাক্কী সূরাগুলো থিওরেটিক্যাল আর মাদানী সূরাগুলো দিয়ে শরীয়া আইন বাস্তবায়ন করা হয়েছে প্র্যাক্টিক্যালি। এভাবে প্রত্যেকটি গ্রুপের সূরা একে অপরের পরিপূরক। তাই বিচ্ছিন্নভাবে নিলে এর অর্থ ও প্রয়োগ বিকৃত হবেই-থিওরী ও প্র্যাক্টিসের মাঝে গ্যাপ থাকার কারণে। এভাবে একটি গ্রুপের একটি সূরা কোনো জিনিসকে হয়তো সংক্ষেপে বর্ণনা করেছে কিন্তু একই গ্রুপের অন্য সূরা সেটি বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। একটি সূরায় হয়তো একটা বিষয় অস্পষ্ট কিন্তু গ্রুপের অন্য সূরা এটিকে স্পষ্ট আকারে বর্ণনা করেছে। একটু সূরা হয়তো একটি মূলনীতি এনেছে কিন্তু অন্য সুরা এটিকে বিশ্লেষণ করেছে। একটূ সূরায় দেখা যাবে ভূমিকা এসেছে আর অন্য সূরায় তার সিদ্ধান্ত বা সমাধান এসেছে। এক সূরায় একটি বিষয়বস্তুর একটা দিক আলোচিত হয়েছে যেখানে অন্য সূরায় একই বিষয়বস্তুর ভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে।
৮। একটি সূরা ও ৭টি গ্রুপ
1. প্রত্যেকটি সূরার একটি বিষয়বস্তু রয়েছে
2. ১১৪টি সূরার ১১৪টি বিষয়বস্তু
3. ১১৪টি বিষয়বস্তু ৭টি মূল বিষয়বস্তুর অধীনে গ্রুপ আকারে রয়েছে। অর্থাৎ ১১৪টি সূরার সকল বিষয়বস্তু মূল ৭টি বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে সব।
৯। একটি সূরা ও বিষয়বস্তু
1. একটি সূরার প্রতিটি আয়াত তার যেই ধারাবাহিকতা আছে সেই ধারাবাহিকতায় তার অর্থ ও প্রসঙ্গের সাথে সম্পর্ক রেখেই চলেছে। অর্থাৎ ১নং আয়াতের সাথে ২নং আয়াতের সম্পর্ক, ২নং আয়াতের সাথে ৩নং আয়াতের সম্পর্ক…এভাবে আয়াতের ধারাবাহিক সম্পর্ক রেখে চলেছে।
2. এভাবে এই ধারাবাহিকতা হিসেবে যখন একটা টপিক শেষ হবে সেটা হবে অত্র সূরার একটা সেকশন(বিশেষত বড় সূরায়-যেমন সূরা বাকারায় ৯টি সেকশন)। যেমন সূরা নাবার ১-১৬ নং আয়াত এসেছে মূল একটা বিষয়কে নির্দিষ্ট ও দৃঢ় করে শক্তিশালী প্রমাণ হিসবে উপস্থাপন করার জন্য—তাহলো
১৭ নং আয়াত। এটাই একটা থিম যা সেকশন।
1. এভাবে ছোট্ট ছোট্ট সূরা হয়তো একটি পূর্ণ বিষয়বস্তু নিয়েই হতে পারে এবং হয়েছে কিন্তু বড় বড় সূরা কয়েকটা সেকশনে দিয়ে একটা পূর্ণ সূরা।
2. একটি সূরার মাঝে যে কয়টি সেকশন-ই থাকুক না কেন, সব সেকশনগুলো মিলেই মূল একটি থিম বা বিষয়বস্তু। সুতরাং একটা সূরার সকল উপ-বিষয় বা অনুচ্ছেদ মিলে একটা মূল বিষয়বস্তু বা অধ্যায়। অর্থাৎ একটা সূরায় যতগুলো সেকশনই আসুক, আপনার কাছে যতই ভিন্ন ভিন্ন বিষয় মনে হোক—আসলে সেগুলো প্রত্যেকটি সূরার মূল একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। অর্থাৎ সূরার কোন কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়—এর আয়াত, সেকশন বা মূল বিষয়বস্তু এবং এদের ধারাবাহিকতা ও পারস্পারিক সম্পর্ক।
3. একটি সূরার আয়াতগুলো ধারাবাহিক সম্পর্কযুক্ত, এর সেকশনগুলোও এভাবে মূল বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত।
4. এভাবে সবগুলো সেকশন যেরুপ সূরার মূল একটি বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত, সেরুপ কয়েটি সূরার মূল বিষয়বস্তু নিয়ে যে গ্রুপ তৈরি হয়েছে, সে গ্রুপভিত্তিক সকল সূরার বিষয়বস্তুগুলো মিলে গ্রুপের একটি মৌলিক বিষয়বস্তু হয়। যেমন সূরা ফাতিহা থেকে মায়িদা মোট ৫টি সূরার একটি গ্রুপ। প্রত্যেকটি সূরার সেকশন রয়েছে, সবগুলো সেকশন নিয়ে সূরা মূল বিষয়বস্তু হলো। অর্থাৎ সবগুলো সূরার একটি করে মূল বিষয়বস্তু হলো। এখন এই সবগুলো মূল বিষয়বস্তুর আলোকে একটা গ্রুপ হলো যার বিষয়বস্তু —ইসলামী শরীয়াহ। অর্থাৎ সবগুলো সূরার কমন আলোচনার দিক ইসলামী শরীয়া। এখন এখানে এমন কিছু দিক পাবেন হতে পারে আদাব বা আখলাক—দেখবেন ঐ ইসলামী শরীয়াতের সাথে এই আদাব বা আখলাক কীভাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে আছে আর এটাই আল্লাহর হিকমাহ। এটাই দয়া, এটাই হিকমাহ, এটাই রাহমাতাল্লিল আলামীন। এই আদাব বা আখলাককে এখন শরীয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করলেন মানে এই সব সূরার মূল বিষয়বস্তুকেই বিকৃত করে ফেললেন। এভাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে সূরার যাবতীয় বিষয়বস্তু একীভূত হয়ে আছে। কেবল নিয়ম নয় এর সাথে রয়েছে জীবনের উচ্চতর অর্থ, আখলাক, বড় কোন উদ্দেশ্য।
7. সবগুলো সূরাই পরিপূর্ণ একটি বিষয়বস্তু নিয়ে আছে। আবার এটি তার গ্রুপকেও পরিপূর্ণ করছে।
8. আবার ধারাবাহিকভাবে এক সূরা আরেক সূরার সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং এভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। যেমন—
A. সূরা ফাতিহার মূল বিষয় হেদায়াত চাওয়া
B. দুই দল হেদায়েত বহির্ভূত—ইহুদি ও খৃষ্টান(আর তাদের মত আমরা হলে আমরাও পথভ্রষ্ট হবো)
C. ইহুদিরা প্রচন্ড জ্ঞানী ছিল—আধ্যাত্বিকতা ছিল না। আর খৃষ্টানরা প্রচন্ড আধ্যাত্বিক ছিল কিন্তু জ্ঞানী ছিল না। দুই দলের একটি করে গুণ ছিল আর অন্যটি অনুপস্থিত ছিল।
D. আমাদেরকে এই দুই দলের মত না হয়ে দুই দলের আধ্যাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক নিয়ে হেদায়েত চাওয়া হয়েছে
— এবার দেখুন পরবর্তী দুই সূরার সাথে সূরা ফাতিহার মিল বা ধারাবাহিকতা ও সম্পর্ক পূর্বের ক্রমানুসারে।
A. দুই দলই (ইহুদি-খৃষ্টান—সূরা ফাতিহা) তাদের কিতাবকে বিকৃত করেছিলো, তাই হেদায়েত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সূরা বাকারাহ ১ম আয়াত বিকৃতহীন কিতাব, যা হেদায়েত মুত্তাকিদের জন্য(২য় আয়াত)। – সুরা ফাতিহার হেদায়াত চাওয়া এখানে পূর্ণ হলো।
B. সূরা বাকারাহ মূলত খৃষ্টানদের নিয়ে। সূরা ফাতিহার একাংশ সূরা বাকারায়—খৃষ্টান সম্প্রদায়।
C. সূরা আলে-ইমরানে ইহুদিদের নিয়ে আলোচিত হয়েছে। যারা বুদ্ধিবৃত্তিকে গুরত্ব দিতো, নিজেরাই নিজেরাই হেদায়েত পাবে ভাবত বুদ্ধির জোড়ে এবং আধ্যাত্বিকতা বা আল্লাহর কাছে চাওয়াকে গুরুত্ব দিতো না। সূরা ফাতিহার আরেক অংশ ইহুদিদের নিয়ে আলোচনা।
দুই সূরায় বর্ণিত হয়েছে তাদের পথভ্রষ্টতার বিবরণ যা সূরা ফাতিহায় সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত হয়েছে।
I. খৃষ্টান সম্প্রদায়, তারা আধ্যাত্বিকতাকেই গুরুত্ব দিতো, আর বুদ্ধিবৃত্তিকে গুরুত্ব দিতো না। তাই তারা নিজেরাই বুদ্ধিহীনতার অভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একারণে তাদের জন্য সূরা বাকারায় বুদ্ধিকে ব্যবহার করার জন্য ক্রমাগত ‘আকল’ শব্দের ব্যবহার করেছেন। –সূরা ফাতিহার একাংশ সূরা বাকারায়—খৃষ্টান সম্প্রদায়।
একারণেই সূরা আলে-ইমরানের প্রথমদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক আলোচিত হয়েছে কিন্তু এর সাথে এই দোয়াও এসেছে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায় থেকে(যারা মুসলিম হবে) যে হেদায়তে দেওয়ার পর আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করো না। — সূরা ফাতিহার আরেক অংশ ইহুদিদের নিয়ে আলোচনা।
II. সূরা বাকারায় বলা হচ্ছে আধ্যাত্বিকতার সাথে আকল ব্যবহার করতে আর সূরা আলে ইমরানে বলা হচ্ছে বলা হচ্ছে আকলের সাথে আধ্যাতিকতার ব্যবহার করতে—অর্থাত ইহুদি ও খৃষ্টান সম্প্রদায় যেকারণসমূহের কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছিল সেগুলো থেকে মুক্ত হয়ে তাদের দুই দলের কম্বাইনেশন হতে—মধ্যমপন্থী হতে যা সূরা বাকারায় ঠিক মধ্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে – “…আর তাদেরকে মধ্যমপন্থী জাতি বানাও”- ১৪৩। সূরা ফাতিহার শেষাংশের সাথে সম্পর্কিত।
এভাবে সূরাগুলো পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত।
9. পূর্বেই বলেছি কীভাবে একটি সূরার সকল আয়াত ধারাবাহিকতা ও পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত থাকে। এবার দেখব একটি সূরার বিষয়বস্তু কীভাবে সম্পর্কযুক্ত থাকে পরিপূর্ণ আকারে চলে আসে সূরা শেষ হওয়ার সাথে সাথে।
সূরা আলে ইমরান —ইহুদিদের নিয়ে আলোচিত যারা আধ্যাত্বিকতা গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের বুদ্ধি দিয়েই মনে করতে হেদায়েতের উপর আছে। কিন্তু তারা আধ্যাত্বিকতা অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ে, তাকে ডাকে না, তাদের বুদ্ধির জড়ে হেদায়েত পেয়েছে মনে করে আল্লাহর কাছে আর কিছু চায় না—এগুলোই সূরার প্রথম দিককার আয়াতগুলোতে আলোচিত হয়েছে। সূরার ১ম আয়াত থেকে ৯ম আয়াত পড়তে থাকুন।
এখানে যে কয়টি বিষয় আলোচিত হয়েছে তাদের মাঝে — কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং কেবল বুদ্ধিবৃত্তি হলেও আল্লাহর দয়া (আধ্যাত্বিকতা) না থাকার কারণে অন্তর বক্র হয়ে যায়…তাই মুসলিমদের আধ্যাত্বিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তি দুটোরই কথা বলা হয়েছে।
১। যেহেতু মুসলিমরা হবে মধ্যমপন্থী আর
২। সূরা ফাতিহাত দুই দলের মাঝে যা নেয়ামতপ্রাপ্ত তাদের পথ দেখাতে বলা হয়েছে…
৩। এখানে সূরা আলে-ইমরানে সেই পথে গিয়েই হেদায়েত চাইল, আল্লাহ হেদায়েত দিবে অবশ্যই
৪। আর আল্লাহর ওয়াদা অবশ্যই সত্য
—সূরা ফাতিহার শেষ আয়াতের পূর্ণতা হচ্ছে আলে-ইমরানের ৭,৮ ও ৯ আয়াতে।
এখন সূরা আলে-ইমরানের আয়াত যেহেতু এখানে শুরু…সমাপ্তি কোথায়? অবশ্যই শেষ হওয়ার সাথে সাথে সূরার শুরুকে পূর্ণতায়ও আনতে হবে।
ইহুদিদের উপর নাযিলকৃত আয়াত-তাই যাদের আধ্যাত্বিকতা ছিল না—অন্তরহীনতা, দোয়া না করা, হেদায়েত না চাওয়া, বুদ্ধির উপর নির্ভর করা, একটি দিক আছে তাদের (যা হেদায়েতের জন্য যথেষ্ট নয় এবং কুরআন যেহেতু মুসলিম ও সমস্ত বিশ্বের জন্য, তাই তাদের যা লাগবে হেদায়েতের জন্য তাও বর্ণনা করা হচ্ছে পূর্বকার লোকদের দৃষ্টান্ত দিয়েই এবং বর্তমানে কি লাগবে তাও বর্ণনা দিচ্ছেন)
নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন অতি সুক্ষ্ণতার সতিহ যে সূরার শুরুকে পরিপূর্ণতায় এনেছেন সূরার শেষে…এভাবে সমাপ্তি। কিন্তু পরিপূর্ণতার বাক্যের ধরণ কিন্তু অনেক রকম।
১। কোথাও প্রথমে এসেছে থিওরী কিন্তু শেষে পরিপূর্ণতা এসেছে প্র্যাক্টিক্যাল হয়ে বাস্তবিক উদাহরণ দিয়ে।
২। কোথাও প্রথমে এসেছে ভ্রষ্টতা আর কারণ আর শেষে এসেছে ঠিক বিপরীত…কারণের কারণে শাস্তি আর ভ্রষ্টতার বিপরীতে যারা সৎ পথে থাকবে!!
সুবহানাল্লাহ!!
সূরার পূর্ণতায় কত বৈচিত্র, কত প্রজ্ঞা। আল্লাহু আকবার!!
—সবগুলো দিক বিবেচনায় এনে গভীর দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যায় যে – আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেই পদ্ধতিগত ধারাবাহিকতায় কুরআনকে সংকলনের নির্দেশ দিয়েছে এতে অবশ্যই প্রায়োগিক দিকের প্রাসঙ্গিকতাকে বজায় রেখেই করেছেন। এবং এই পদ্ধতি ব্যতীত বুঝতে গেলে উপলব্ধিতে অবশ্যই ব্যত্বয় ঘটবে। যেকোন আয়াতকে বিচ্ছিন্ন বা সেপারেটলি নিলে যেকেউ নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করতে পারবে কিন্তু ধারাবাহিক যোগসূত্রের পারস্পপারিক প্রাসঙ্গিক আকারে নিলে এই সমস্যা থাকে না- অর্থাৎ কেউ নিজের ইচ্ছামত আয়াতকে ব্যবহার করতে পারবে না। এটাই তাদাব্বুরের ধারাবাহিকতার (নাযম আল-কুরআন)সবচেয়ে বড় বিষয় যা প্রত্যেক সমস্যা বা মতবিরোধ, দ্বন্দের বিরোধ নিষপত্তি করবে।কারণ বক্তব্যের যেরুপ শুরু আছে সেরুপ শেষও রয়েছে প্রত্যেকটি সূরায় এবং বক্তব্য ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই কথার মাঝে পারস্পারকি সম্পরক বজায় রেখে শুরুর বক্তব্যকে পূর্ণতা দিয়ে শেষ করে।
কুরআনের মেজর সাতটি গ্রুপ/বিভাগ নিম্নরুপঃ
এই ধারাটি যা বুঝাচ্ছে তা হলো প্রত্যেকটি সূরা একটি ধারাবাহিক ভাষণ, যা প্রতিটি জোড় আকারে সাজানো রয়েছে এবং এভাবে সবগুলো সূরা মেজর সাতটি ভাগে বিভক্ত। এভাবে সম্পূর্ণ কুরআন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পর্কযুক্ত ও সুশৃংখল কিতাব(well-connected and systematic book)।প্রত্যেকটা ভাগেই একেকটা ভিন্নভিন্ন বিষয়বস্তু(Theme) রয়েছে। এবং এ বড় বড় বিভাগে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচিত হয়েছে সেগুলো মোটামুটি ধারাবাহিক নাযিলের পদ্ধতিতেই সাজানো রয়েছে (লক্ষ্য করুন আমপারা কিন্তু মাক্কী এবং এক সাথেই রাখা হয়েছে এবং বিষয়বস্তুও কিন্তু একই)। এভাবে সূরাগুলোও জোড় আকারে রয়েছে। এ জোড় কখনও দুটি সূরা মিলে, কখনও তিনটি মিলেও হতে পারে। আর প্রত্যেকটি জোড় সূরাগুলো একে অন্যের সাথে বিভিন্নভাবে পরিপূরক হিসেবে রয়েছে—তাই বিচ্ছিন্নভাবে এগুলো পড়লে ভাব ও বিষয়বস্তুর উপলব্ধির ক্ষেত্রেও পূর্ণ উপলব্ধি আসবে না।
এ গ্রুপ কীভাবে করা হলো? প্রথমত একটি সূরাকে বিষয়বস্তু পরিবর্তনের আলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। তারপর প্রত্যেকটি ভাগ পর্যায়ক্রমে পাঠ করা হয় যতক্ষণ না একটা আইডিয়াকে ঘিরে কতগুলো আয়াত এসেছে এভাবে একত্রিত হয়। এভাবে বিষয়বস্তুর আলোকে একটি সূরা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়। সর্বশেষে সূরাটির সবগুলো সেকশনের মূল নির্যাস নিয়ে সেগুলো একত্রিত করে একটি মৌলিক স্বাতন্ত্র বিষয়বস্তু বের করা হয় যা ঐ সূরার একটি বক্তব্যমূলক মূল বিষয়বস্তু।
প্রত্যেকটি সূরার যেমন মূল বিষয়বস্তুর রয়েছে এবং এর অধীনে তার অনেক উপ-বিষয়বস্তু থাকে। তেমনি সবগুলো সূরার বিষয়বস্তু মিলে আবার বড় বড় সাতটি মৌল বিষয়বস্তু রয়েছে।
পবিত্র কুরআনের মেজর সাতটি গ্রুপ নিম্নরুপ:
তাফসীর পড়ার সময় যখন সূরা ফাতিহা থেকে শুরু করবেন তখন দেখতে পাবেন প্রত্যেকটি আয়াত, সূরা এবং গ্রুপ তাঁর আয়াত ও জোড় সূরার সাথে কীভাবে সুনিপুনভাবে একটি আরেকটির সাথে বিষয়বস্তু, ধারাবাহিকতা ও পারস্পারিক সম্পর্ক অনুসারে গ্রথিত।
এতক্ষনে সামগ্রিক যোগসূত্রের প্রকাশ্য দিক কিছুটা হলেও বলা হয়েছে। এখন এর গোপন দিকগুলো নিয়ে কিছু বলা যাক।
সামগ্রিক যোগসূত্রের গোপন দিক
মোট সাতটি বড় গ্রুপকে এভাবে পড়লে, এর ভেতরের কত হেকমত, রাশি রাশি জ্ঞানভান্ডারের কি বিশাল দিক লুকিয়ে আছে তার অনেক দিকই ভেসে উঠবে অনায়াসেই।১। প্রতিটি সূরা একেকটি বক্তব্য আর এজন্য প্রত্যেকটি সূরার একটি মূল বা প্রধান নির্দিষ্ট বিষয় থাকে। যার সাথে সূরার অংশগুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে এবং একে কেন্দ্র করেই সেগুলোর আলোচনাধর্মী আবর্তন চলতে থাকে। তদ্রুপ প্রতিটি গ্রুপেরও একটা সামগ্রিক বিষয়বস্তু রয়েছে। যার সাথে গ্রুপভূক্ত সূরাগুলোর নাড়ীর সম্পর্ক। উদ্দেশ্য মূলত অভিন্ন বটে কিন্তু সে অভিন্নতার সাথে সামগ্রিক বিষয়বস্তুর প্রাধান্য সর্বত্র বিরাজমান। কোনো গ্রপে শরীয়াতের বিষয়াবলীর প্রাধান্য, কোনো গ্রুপে মিল্লাতে ইব্রাহীমের ইতিহাস, ঐতিহ্য, হক-বাতিলের সম্পর্ক ইত্যাদির প্রাধান্য। কোনো গ্রুপে রেসালাত, এর প্রয়োজনীয়তা ও এর বৈশষ্ট বর্ণনা রয়েছে। কোনটিতে তাওহীদ, এর প্রমাণ ইত্যাদির বর্ণনা এসেছে।
২। গভীর দৃষ্টিতে অধ্যয়ন করলে বুঝা যায় যে মাদানী গ্রুপের সূরাগুলোর মর্ম ও ভাবগত দিক থেকে গ্রুপের সামগ্রিক ভাবধারার সাথে সম্পূর্ণ একাত্ব। অনুরুপ সে গ্রুপের মাক্কী সূরার সাথেও শিকড়-শাখার ন্যায় ভাব সাদৃশ্যের একটা অনাবিল সম্পর্ক বিদ্যমান দেখতে পাওয়া যায়।
৩ । এক সূরায় কোনো বিষয় অস্পষ্ট বর্ণিত হলেও সে গ্রুপের অন্য সূরা বিষয়টিকে স্পষ্ট ও ব্যাখ্যা করে দেয়। অর্থাৎ গ্রুপের সূরাগুলোর পারস্পারিক বর্ণনা একে অপরের শূন্যতা পূরণ করে দেয়। যে কারণে গ্রুপভূক্ত সুরাগুলো পরস্পর সমার্থবোধক হিসেবে ভাবের সেতু রচনা করে বর্ণনার আকাশে যেন মানিকজোড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যভাবে বলা যায় উভয়ের মাঝে চন্দ্র-সূর্যের সম্পর্ক। একারণেই রাসুল (সা) সালাতে যেসব সূরা তিলাওয়াত করতেন সেগুলোকে ভাবের মিল রেখেই জোড় মিলিয়ে চয়ন করতেন। সূরা কিয়ামাহর সাথে সূরা দাহর, সূরা আস-সাফফ এর সাথে সূরা জুমূয়া এবং সূরা আ’লার সাথে সূরা গাশিয়া মিলিয়ে সালাত আদায় করতেন।
৪। অবশ্য সূরা ফাতিহা সমগ্র কুরআনের ভূমিকার সুবাদে উক্ত নিয়মের বিপরীত। কারণ এটি নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, সমস্ত কুরআনের মৌলিক দিক সমন্বিতভাবে আলোচিত হয়েছে। এ কারণেই এর অপর নামগুলোর মাঝে ‘কাফিয়া’-পরিপূর্ণ, উম্মুল কুরআন ইত্যাদি বলা হয়।
৫। কুরআনের কোনো কোনো সূরা অনুগামী পর্যায়ের, যা অন্য সূরার সমকক্ষ হওয়ার মর্যাদা রাখে না। বরং পূর্ব সূরার কোনো প্রচ্ছন্ন দিক স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে।
৬। প্রতিটি গ্রুপের বিষয়বস্তু নিয়ে পৃথক পৃথক চিন্তা করা হলে স্পষ্টত বুঝা যায়— শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইসলামী দাওয়াতের পর্যায়গুলো সকল গ্রুপে সমাহারে আলোচিত হয়েছে। তবে এ আলোচনার ধরণ ও দিক ভিন্ন। আর সংক্ষেপন ও বিস্তৃতির প্রকৃতিও এক নয়।
৭। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়—উল্লিখিত গ্রুপগুলোর মধ্যে বিধি-বিধান ও শরীয়ত বিষয়ক গ্রুপকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়া হয়েছে। আর সাজা-শাস্তি, ভয়-ভীতিমূলক বিষয় গ্রুপ এসেছে সবার শেষে। এদ্বারা ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যে মানুষকে ভ্রান্ত পথের অনুসরণ থেকে সরিয়ে সঠিক পথে দাড় করানো, তারই ইংগিত পাওয়া যায়। আর অভ্রান্ত সে পথটি যে একমাত্র ইসলামী শরীয়াত—সে কথা বলাই বাহুল্য। কাজেই যে বিষয়টি মূল উদ্দেশ্য তার আলোচনা সবার আগে হওয়াটাই সঙ্গত কথা। ইসলামী শারীয়াত উম্মাতে মুসলিমাহর শ্রেষ্টতম সম্পদ। যা অবমূল্যায়নের পরিণামে আহলে কিতাবদের কাছ থেকে ছিনিয়ে মুসলিম জাতির দায়িত্বে অর্পন করা হয়েছে। সে কারণে তাদের পদচ্যুতি ও ইসলামী শরীয়াতের গতি-প্রকৃতি ও মূল্যবোধের তফসীলী আলোচনা প্রথম গ্রুপে স্থান পাওয়াটাই সঙ্গত ছিল, কার্যত তাই হয়েছে। স্থির মনে চিন্ত করা হলে অনায়াসে বুঝে আসার কথা কুরআনের প্রথম ও শেষ গ্রুপের পারস্পারিক সম্পর্ক একটি ইমারাতের ভিত্তি ও নির্মাণ কাঠামোর সম্পর্কের অনুরুপ। নির্মাণের বিধান সূত্রে ভিত্তি গড়ানো হয় সর্বাজ্ঞে। এতঃপর অবকাঠামো নির্মাণে হাত দেয়া হয়। কিন্তু কাজ শেষে অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে যায়। এখন অবস্থা হলো – সবার আগে শুরু করা ভিত্তি নিচে গেলো। সামনে ভাসে কেবল উপরে দাঁড়ানো ইমারাতের বিশাল দেহ কাঠামো।
কুরআন দ্বারা কুরআনের তাফসীর এবং কিছু দৃষ্টি
কুরআন এ মর্মেই নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
কুরআন নিজে কথাটা বার বার স্পষ্ট করেছে— জ্ঞান-গবেষণা ও হেকমতপূর্ণ বিষয়গুলো তাতে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ব্যক্ত করা হয়েছে। এজন্য ‘তাসরীফ’ শব্দের প্রয়োগ একাধিক পাওয়া যায়। যার অর্থ ঘুরানো। কুরআন পাঠকালে একই বিষয় বিভিন্ন সূরায় বার বার আলোচনা দ্বারা কথাটা বুঝে নিতে আপনার আদৌ কষ্ট হবে না। ফলে শিক্ষানবিশের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এটাতো একই কথার পূনরালোচনা মাত্র। কিন্তু চিন্তাশীলদের সামনে কথা পরিষ্কার—একই বিষয়ে নিরেট পুনঃচর্চা ও পুনরাবৃত্তির দোষ থেকে কালামে ইলাহী সম্পূর্ণ মুক্ত ও পূত-পবিত্র মর্যাদায় আসীন। কেননা বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও একই কথার পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয়, আসলে ব্যাপার তা নয়। এক কথাই আলোচনায় যতবার আসুক না কেন, প্রত্যেকবার সেগুলোর প্রসঙ্গ ও পরিবেশ ভিন্ন ভিন্ন থাকে এবং ঠিক সেই ভিন্ন প্রসঙ্গের সাথেই ঐ অংশটুকু যায়। একারণে একই কাহিনীর সবটুকু সব জায়গায় আসে না কিন্তু যে জায়গায় যতটুকু এসেছে সেইটুকু সেই জায়গার প্রসঙ্গের সাথে মিল রেখেই এসেছে। গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই তা প্রতীভাত হয়।
আর কিছু কিছু বিষয় একই কিন্তু বারবার আলোচিত হয়েছে বরং একটাতো প্রসঙ্গের ব্যাপার রয়েছেই আরেকটি দিক হলো শ্রোতার মনে কোন কিছু গাঁথতে চাইলে সেগুলোর বারংবার আলোচনা জরুরী। সুতরাং এভাবে এগুলোও পূর্বাপর বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ও পারস্পারিক সম্পর্কযুক্তই বটে।
আয়াত সমষ্টির পারস্পারিক যোগসূত্র ও ব্যাখ্যা নির্ধারণে মূলত কুরআনের ওপরই নির্ভর করেছি। এমনকি শাব্দিক ও বর্ণনাগত জটিলতা নিরসনে প্রায় ক্ষেত্রে কালামে ইলাহীকে আমি অনুসরণ করেছি। এর কারণ এটা ছিল না যে, আরবী ব্যাকরণ বা অভিধানের উদৃতি দিতে আমি অপারগ ছিলাম। আমি বরং এটাই দেখাতে চেয়েছি—মর্ম ও ভাবের ন্যায় শব্দ ও সাহিত্যিক জটিলতা নিরসনের ক্ষেত্রেও অন্য সবের তুলনায় কুরআনই সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ও বিকল্পহীন সুত্র। আমাদের পূর্ববর্তী আলেমগণ এ মূল কথাটা স্বীকার করতে কুন্ঠাবোধ করেননি।
এভাবে আরো অন্যান্য সোর্সের ব্যাপারেও
কিছুটা আলোচনা করেছেন যা বইতে পাওয়া যাবে। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাযম ও
তারতীব(যোগসূত্রের সম্পর্ক ও পারস্পারিক ধারাবাহিকতা) কে হাইলাইট করা, যা
করেছি। আরো বিস্তারিত বইতে পাবেন।
কেন এটি বৈচিত্রময়, ভিন্নতর কিন্তু গভীরতর?
ইতোমধ্যে ধারাবাহিকতা ও পারস্পারিক সম্পর্কের গুরুত্ব আলোচিত হয়েছে। এ পর্যায়ে এই তাফসীরগ্রন্থের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিকেরও আলোচনা কিছুটা হওয়া উচিত যা এ তাফসীরকে করেছে অনন্য ও হিকমাহপূর্ণ গভীরতর দৃষ্টির উজ্জ্বল দিক।
সূরা আলোচ্য বিষয় – প্রতিটি সূরা আলোচ্য বিষয় সংক্ষিপ্তাকারে আলোচিত হয়েছে। একারণে সম্পূর্ণ সূরায় কতগুলো বিষয়ে আলোচিত হয়েছে এবং এগুলোর মাঝে সম্পর্ক কি সব স্বল্পাকারে বর্ণনা করে ছোট্ট পরিসরে একটা ছবি দেওয়া হয়েছে।
১। কুরআনের শব্দমালার অনেক শব্দই প্রায়োগিক কিন্তু এর প্রায়োগিক দিক নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, ধারাবাহিকতকা ও গভীরতর চিন্তা ব্যতীত আনা সম্ভব নয়। অর্থাৎ কুরআনের নির্দিষ্ট আয়াতকে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে উপলব্ধির মাধ্যমেই উপলব্ধির গভীরতা ও হেদায়েতের চরম শিখরে যাওয়া যাবে। এখানেই এই তাফসীরের চিন্তন-প্রক্রিয়ার অনেক বড় উপাদান রয়েছে এর প্রতিটি পাতায়। এই তাফসীর পড়ার পূর্বে হয়ত অনেক ব্যাখ্যা পড়েছেন কিন্তু এটি পড়ার সাথে সাথে আপনার নতুন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, চিন্তার ধারা শাণিত হবে নতুনভাবে।
২। সমকালীন প্রাসংগিকতা – কেবল তাদাব্বুর করেই তিনি ক্ষান্ত হননি বরং এর সাথে এসবের বাস্তবিক প্রয়োগও দেখিয়েছেন সমকালীন চিন্তার আলোকে যা অন্যান্ন ক্লাসিক্যাল তাফসীরে অনুপস্থিত রয়েছে। এভাবে তিনি সমকালীন সমস্যাগুলোকেও তুলে এনে তাঁর সমাধান করতে চেষ্টা করেছেন কুরআনের গভীরতর চিন্তার উপলব্ধির আলোকে।
৪। পূর্বকালীন তাফসীরকারক যেসব আয়াতগুলোকে এর অন্তর্নিহিত ধারাবাহিকতার সাথে অর্থের মূলভাবকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন সেগুলোকে প্রাসঙ্গিকতা থেকে অসঙ্গতি তুলে ধরে কোন অর্থটি আসবে তা সামগ্রিক দিকের চিন্তা থেকে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সেকশন থেকে আমরা নতুনভাবে কুরআনের সঠিক অর্থ ও প্রায়োগিক দিক জানতে পারবো।
৫। এই তাফসীর কয়েক ভাগে এর গভীরতর বর্ণনা এসেছে।
পূর্ব ইতিহাস পাঠ — যা প্রাসংগিকতাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে আয়াত বা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুকে সঠিকভাবে অর্থ নির্দেশ করতে সাহায্য করে। যেই প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে, যে ধারায় তারা ছিল, যে মানে তারা ছিল সবই আলোচিত হয়েছে যাতে আয়াতের নির্দিষ্ট এবং যে উদ্দেশ্যে আয়াতটি বা আয়াতগুচ্ছ বা সূরা নাযিল হয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে ব্যবহার উপযোগী হয় তা লক্ষ্য রেখেই যেই অংশটুকু আয়াতগুলো বর্ণনার পূর্বেই আলোচনা দরকার তা আগেই ভূমিকাস্বরুপ আলোচিত হয়েছে আর যেগুলো আয়াতের সাথে আলোচনা হওয়া দরকার সেগুলো নির্দিষ্ট জায়গায়ই আলোচিত হয়েছে।
পারিভাষিক পাঠ – প্রায়োগিক দিক থেকে বিচ্ছিন্নভাবে শব্দের পারিভাষিক পাঠ নিলে কীভাবে তা সঠিক অর্থ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে এবং ভুল প্রয়োগ হতে পারে সেগুলোকে তিনি নির্দিষ্ট স্থানের প্রাসংগিকতায় আলোচনা করেছেন।
ভাষাগত দিক – একই বিষয়বস্তুর জন্য বিভিন্ন স্থানে, ভিন্নভিন্নভাবে ভাষার প্রয়োগ করা হয়েছে কেন?…বা ভাষার প্রয়োগের সাথে শিক্ষার উদ্দেশ্য বা এর ব্যবহারিক প্রয়োগ-ই কেন ভিন্ন হচ্ছে বা ভাষার বিভিন্ন স্টাইল ব্যবহার করার উদ্দেশ্য কী? ভাষার এসব বৈচিত্রের মাঝে যে প্রসঙ্গের সাথে শিক্ষার গভীরতর সম্পর্ক রয়েছে এবং এ উপলব্ধির ছাড়া শিক্ষা বা প্রয়োগে ভুল হতে পারে। সুতরাং ভাষার মাঝে থাকে ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্যের গোপন দিক। সুতরাং ভাষার সুক্ষ্ণ দিক, বিভিন্ন স্টাইল, বিভিন্ন প্রয়োগ বুঝতে ব্যর্থ হওয়া মানে আল্লাহর উদ্দেশ্য বুঝতে ব্যর্থ হওয়া যার কারণে ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝতে ও কার্যকরও করতে পারবো না। এভাবে তিনি ভাষাকে অতি গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করেছেন।
যোগসূত্র ও পারস্পারিক সম্পর্ক – এ তাফসীরের মূল জিনিস-ই এটি যা পূর্ণ আর্টিকেল জুড়েই আলোচিত হয়েছে।
হেকমত বা প্রাজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষা – তথ্য, জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা। আপনার কাছে প্রচূর তথ্য থাকতে পারে, এভাবে এই তথ্যের মাধ্যমে প্রচূর জ্ঞানও থাকতে পারে। কিন্তু প্রজ্ঞাই এসবের মূল অর্থাৎ আপনি যদি এর সঠিক স্থানে, সঠিকভাবে, সঠিক মাপে প্রয়োগ করতে না পারেন তবে এসবের কোন লাভ নেই। একারণেই রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বা সকল নবী-রাসূল পাঠানোর একটা উদ্দেশ্য থাকে ‘হিকমা’ শিক্ষা দেওয়া(সূরা বাকারাহ)। এভাবে আপনার কাছে কুরআনের প্রচূর জ্ঞান থাকতে পারে কিন্তু এগুলোর সঠিক শিক্ষাকে ঠিকমত কাজে লাগাতে না পারলে এ থেকে উপকারিতা পাবেন না। এ কারণেই ওমর(রাজিয়াল্লাহু আনহু) এর সুরা বাকারা শেষ করতে তিন বছর লেগেছিল—কারণ, কুরআনকে বুঝতে, তাদাব্বুর বা গভীরতর চিন্তার মাধ্যমে এর ভেতরের হিকমাহকে উপলব্ধি করতে এবং এর প্রজ্ঞা অনুযায়ী আমল করে উপকার নিতে হয়েছে।
সাধারণ চিন্তার বাহিরে উপলব্ধি— হ্যা, এটাই তাদাব্বুর। কুরআন সাধারণভাবে আয়াতের অর্থ বা তাফসীরের বাহিরেও যখন একে প্রজ্ঞার জ্ঞানে রুপান্তরিত করে এর সঠিক উপলব্ধির মাধ্যমে বিশুদ্ধ প্রয়োগে উপকারিতা পাবো। এভাবে সাধারণভাবে যেসব প্রজ্ঞা লুকিয়ে আছে আয়াত, সূরা, গ্রুপ এবং এদের ধারাবাহিকতা এবং পারস্পারিক সম্পর্কের ভেতরে—সেগুলো উদ্ধার করে ইসলামী শরীয়াহর মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন পালন করে সর্বোচ্চ উপকারিতা পাওয়া-দেওয়া।
এভাবে কুরআনের অনেক ডাইমেনশন-ই আলোচিত হয়েছে অত্র তাফসীরের ধারায়। এই কুরআনের তাফসীরের তাদাব্বুরের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর প্রজ্ঞার নিদর্শন উপলব্ধি করে দ্বীনের সর্বোচ্চ কল্যাণ লাভ করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দিন—আমীন।
তাদাব্বুরে কুরআন ও এর কিছু পদ্ধতি
নবী-রাসূলদের পাঠানোর একটা উদেশ্য ছিল – হিকমাহ শিক্ষা দেওয়া। সুতরাং বুঝতেই পারছেন কুরআনের হিকমাহর মাঝে মানবজাতির সকল সমস্যার সমাধান নিহিত। এ হিকমাহ রয়েছে তাদাব্বুর করার উপর। একারণ ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়লনা, সে কুরআন শরীফকে বর্জন করল।আর যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়ল অথচ তা নিয়ে তাদাব্বুর করলনা সেও কুরআনকে বর্জন করল।আর যে ব্যক্তি তাদাব্বুর করলো অথচ এর উপর আমল করলনা সেও কুরআনকে বর্জন করল।কুরআনের তাদাব্বুরের উপকারিতা হলো এর মাধ্যমে প্রজ্ঞার অসীম নিদর্শনের উজ্জ্বলতায় ঈমান জীবন্ত হয়, উপদেশ গ্রহণের বড় দ্বার উন্মুক্ত হয়।
এজন্য উপদেশ নেওয়ার জন্য কেবল পড়লেই হয় না, বরং উপলব্ধি করে তাদাব্বুর করতে হয়। এজন্যই তারতীল।
১। তাদাব্বুরের সাথে উপদেশ গ্রহণ আল্লাহ শর্ত দিয়েছেন। সুতরাং আমার-আপনার মতের বিপরীতে কুরআনের তাদাব্বুর থেকে কিছু আসলে সেটাই গ্রহণ করা। নতুবা তাদাব্বুর আসবে না। তাদাব্বুরের ইলম ও এর আমল।
২। কুরআনের কাছে যাওয়ার আদাবকে প্রচন্ড গুরুত্ব দিন—পবিত্রতা, ইসতিগফার, নিয়তের বিশুদ্ধতা, তাদাব্বুর করতে পারেন এরকম পরিবেশ।
৩। আপনি কি চান সেটা নয়, আল্লাহর কুরআনের প্রজ্ঞা ও বারাকাহ কি সেটা জানতে চেষ্টা করুন। সুতরাং মুক্ত মনে বসুন, চিন্তা করুন ও নিজ দল-আন্দোলনের চাহিদা থেকে নয়, আল্লাহ কি বলেছেন সেটা জানতে বসুন। আল্লাহর বাণীতে সবই আছে – এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বসুন হেদায়েত পাওয়ার নিমিত্তে।
৪। তারতীলের সাথে তিলাওয়াত। কারণ কুরআন সকল প্রকার হিদায়াতের জন্য। এজন্যই রাসূল সা কে এ আদেশ দেওয়া হয়েছি যাতে এ থেকে প্রশান্তি, উপলব্ধি নিয়ে ঠিকমত কাজে নামতে পারে।
৫। আয়াতের তাৎপর্য, মর্ম, প্রজ্ঞা নিয়ে অন্তরের বাস্তবায়নের প্রভাব সৃষ্টি করা। রাসূল (সা) আযাবের আয়াতগুলো পড়ে কাঁপতেন অথচ তিনি? জান্নাতুল ফিরদাউসের অধিকারী, যার সকল গুনাহ মাফ।
৬। কুরআনের প্রজ্ঞা কিয়ামাতের পূর্ব পর্যন্ত চলবে। সুতরাং এর প্রজ্ঞা শেষ হবে না। সুতরাং পূর্বে যারা তাফসীর করেছেন সেটাই শেষ নয়। আল্লাহর প্রজ্ঞা যুগে যুগে চলছে, চলবেই…সুতরাং আপনার তাদাব্বুরের সাথে আপনাকে আল্লাহ তাঁর প্রজ্ঞার দোয়ার খুলে দেবে।
৭। কুরআনের বৈশিষ্ট হলো এটি থেকে যে কেউ যেকোনো পরিমাণ হেদায়েত নিতে পারে। এটি বৈশ্বিক। রাস্তার একজন ফকির এটি থেকে হেদায়েত নিয়ে জান্নাতে যেতে পারে অথচ তাঁর উন্নত চিন্তা-গবেষণা নেই। তদ্রুপ একজন পিএইচডি ডিগ্রীধারী হেদায়েতের সেই একই উপকরণ থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী হয়ে এ থেকে প্রচন্ড শক্তিশালী প্রজ্ঞা পেতে পারে। সুতরাং চিন্তা করুন…আল্লাহর প্রজ্ঞা সীমাহীন…আপনার উপকারিতা সেই হিসেবে পাবেন। সুতরাং ১টি বিষয় নিয়ে ২০ শ্রেষ্ট মুফাসসির তাফসীর করেছেন কিন্তু আপনি চেষ্টা করুন…আপনার সম্মুখেও আল্লাহর অবারিত প্রজ্ঞার স্পর্শ এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যা আগে কেউ সেদিকে নজরই দেয়নি।
৮। চিন্তা করবেন কীভাবে?
আল্লাহ সর্বোচ্চ জ্ঞানী-আল-আলীম, প্রজ্ঞাময়-আল-হাকীম, সর্বদৃষ্টকারী-আল-বাসীর—সুতরাং সর্বোচ্চ জ্ঞানী আল্লাহ তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন সব যার সর্বদিক থেকেই প্রজ্ঞায় ভরপুর।
আমাদের লেটেস্ট আবিষ্কার 3D আর আল্লাহ বলছেন তিনি যে প্রজ্ঞার মালিক তা সবদিক থেকেই প্রজ্ঞার নিদর্শন রাখে।
সুলাইমান (আ) নিয়ে পড়ছেন? পিপড়া এসেছে?…ইউটিউবে বা গুগুলে সার্চ দিয়ে রিসার্স দেখুন পিপড়া নিয়ে, এর কমিউনিকেশন সিস্টেম নিয়ে, কয়জন পিপড়া নিয়ে পিএইচডি করেছে—সেগুলো দেখুন ভালো করে। কি? কিছু প্রজ্ঞার স্পর্শ পান? অভূতপূর্ব অনেক কিছুই পাচ্ছেন!! আল্লাহ উটকে কীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে নজর দিতে বলেছেন? কেন?—একটু খুজেই দেখুন কি অবাক কান্ড!! শুকরকে হারাম করেছেন কেন? সার্চ দিয়ে দেখুন।
সালাতকে আল্লাহ মন্দ-কাজ থেকে বিরত থাকার ঔষধ বললেন কেন? সাহাবারা (রা) মন্দ থেকে বিরত থাকতে পারতেন কিন্তু আমরা পারি না…কারণ কী? একটু খুজুন, ডুব দিন।
সূরা বাকারায় বললেন- “কিসাসের মাঝেই তোমাদের জীবন নিহিত”। সাধারণ মানুষ দেখবে কিসাসের মাধ্যমে জীবন যায় আর আল্লাহ বলছেন জীবন আছে!! এটাই পার্থক্য। এজন্য আল্লাহ এই আয়াতের বুঝ কাদের দিয়েছেন জানেন?…আয়াতের শেষে যান—উলুল-আলবাব—প্রচন্ড জ্ঞানীদেরকে।
হাজার হাজার মানুষ জেলে কিন্তু অপরাধ কমে না। কারণ হাজার মানুষের জেলের ভেতরের কষ্টগুলো বাহিরের অপরাধীরা দেখে না। তাদের হৃদয়ে নাড়াও দেয় না।
একটি রাজ্যের সকল অপরাধীদের সামনে একটি হত্যার বদলে প্রকাশ্যে হত্যা করুন—দেখুন এই হত্যার শাস্তি দেখে অন্যান্য অপরাধীর সাইকোলজি কীভাবে কাজ করে…সে ভিক্ষা করে খাবে কিন্তু অপরাধ করতে যাবে না। এটাই কষ্ট দেখা আর না দেখার মাঝে সাইকোলজির পার্থক্য।
হাজার হাজার চুর জেলের ভেতর কিন্তু চুর কমে না। একজন চুর তার কাটা হাত নিয়ে যেখানেই যাবে —সব চুরকে সেই কাটা হাত সতর্ক করে দিবে…। এটাই একটা কিসাসের বদলে অন্যান্য সকল অপরাধী ভালো হওয়ার পথ দেখাবে, সকল ভুক্তভোগীরা প্রশান্তি জীবন কাটাবে——-এটাই “কিসাসের মাঝে তোমাদের জীবন”।
৯। একটা বিষয়কে চাতুর্মুখিকভাবে দেখুন। কারণ প্রজ্ঞাময় আল্লাহ কিন্তু আল-বাসির…। বাসির মানে যতদিক আছে, সবদিকই যিনি দেখেন, অবলোকন করেন। সুতরাং বাক্সের বাইরে চিন্তা করুন। আপনার উস্তাদ ১টা বিষয়ে ১০টা প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন, আপনি আরো ৫টা খুঁজুন। কারণ তাঁর ব্রেইন আল্লাহর দান, আপনারটাও আল্লাহর দান কিন্তু প্রত্যেকটা ব্রেইন ই ইউনিক—অদ্বিতীয়।
১০। আল্লাহর কাছে চান, রাসূল (সা) ও সাহাবারা (রা) চাইতেন। এই হেদায়াত আল্লাহর দান, এটা চিন্তার ফসল কিন্তু বিশুদ্ধ চিন্তা করার তাওফিক আল্লাহর দান। সুওরাং হেদায়াত চান আল্লাহর কাছে যেন তিনি দ্বার খুলে দেন। ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) কোন সমস্যায় পড়লে সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন, ব্যাস সমস্যা খুলে যেতো তাঁর নিকট।
১১। তাদাব্বুরে কুরআনে কতভাবে আয়াত, সূরা, সূরার সেকশন, গ্রুপ বিভাগ, এদের ধারাবাহিকতা, পারস্পারিক সম্পর্ক, আবার সম্পর্কগুলো কতভাবে, হুকুমের সাথে আখলাকের সম্পর্ক, কিসাসের সাথে ক্ষমাকে উত্তম বলা, একটি সূরা কত স্টাইলে, কত ধরণের শিক্ষা নিয়ে, প্রথম ও সমাপ্তির সম্পর্ক কীভাবে হয় — ইত্যাদি নিয়ে একটু গভীরে ডুব দিন।
সূরা নূরের প্রথমদিকে আলোচনা এসেছে আধ্যাত্বিকতা নিয়ে আর পর্দার আয়াতগুলো এসেছে এর কিছু পরে। সুতরাং পর্দা বা আপনার চক্ষু অবনত না করা বা জিলবাব না দেওয়ার সাথে সূরার প্রথমে যে আধ্যাত্বিকতার কথা বলা আছে সেটার ঘাটতির সম্পর্ক অবশ্যই আছে!!
১২। যেকোনো বিষয় এসেছে, এর জন্য আপনার বর্তমানে হেদায়েত দরকার। যেমন ধরুন কুরআনে জিহাদ নিয়ে কথা এসেছে—তাহলে এর থেকে প্রজ্ঞা নিতে হলে ইসলামী জিহাদের মূলনীতি, জিহাদনীতি, ঐ সময়কার সমগ্র পৃথিবী বা আরবের সকল রাজ্যের যুদ্ধনীতি কি ছিল, এখনকার যুদ্ধনীতি কেমন—সব এনে এনালিসিস করলে ভালো ফল পাবেন। এখন যেখানে যুদ্ধে ধর্ষণ হয়, বেসামরিকদের মারে—অথচ ইসলামী জিহাদের উদ্দেশ্য অন্যায় নির্মূল করা, জুলুম নির্মূল করা—তাই নারী, শিশু, বৃদ্ধদের কোন ক্ষতি করা হারাম—শস্য বা ফসল বা খাদ্যদ্রব্যকে নষ্ট করা হারাম। অথচ আধুনিক যুদ্ধের বিপরীতে এগুলোর সাথে তুলনা করুন। ইসলামে যুদ্ধ মানে প্রোডাক্টিভ কিছু, কোনো ধ্বংস মানে জালিম ধ্বংস, সাধারণের জন্য সকল উপকারিতার দ্বার উন্মুক্ত।
১৩।
I. একটি আয়াত, এবং এ সংক্রান্ত কুরআনের সকল আয়াত আনুন ও এ দিয়ে সামগ্রিক চিন্তা আনুন, গভীর বিশ্লেষণ করুন।
II. এভাবে আয়াতটি কোন সেকশনে রয়েছে এবং এভাবে সেকশনের উদ্দেশ্য, গভীরতা, প্রজ্ঞা বিশ্লেষণ করুন।
III. এভাবে সূরার সবগুলো সেকশনের মাঝে গভীরতা খুঁজুন।
IV. এভাবে সবগুলো সেকশন মিলে পূর্ণ সূরার মৌলিক বিষয়বস্তুর গভীরতা জানুন।
V. সূরার আগের এবং পরের সূরার থিমের সাথে নাযম ও ধারাবাহিক তারতীবের সাথে সম্পর্ক নির্নয় করুন।
VI. এবং সূরার বিষয়বস্তু হলে এটি বড় ৭টি গ্রুপের কোন গ্রুপে আছে এবং এ গ্রুপের সাথে সামগ্রিক চিন্তার গভীরতায় আনুন, বিশ্লেষণ করুন।
তাদাব্বুরে কুরআন করার ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা
২. দুআ না করা। হেদায়াত মানে হাদিয়া—আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার। যা দুনিয়াবী নয়, আল্লাহ প্রদত্ত। সুতরাং এটা আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে।
৩. আরবি ভাষার ভালো জ্ঞানের অভাব। কারণ ভাষায় মধ্য দিয়ে গভীর জ্ঞানের প্রকাশ আল্লাহ বুঝিয়েছেন কুরআনের প্রতিটি শব্দ বাক্য, আয়াত ও সূরায়।
৪. কুরআন শরীফ অনুধাবন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্দ্ধকতার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করা।
৫. বিভিন্ন তাফসীর ও উলূমুল কুরআনের কিতাবাদী ভাল করে অধ্যয়ন না করা।
এগুলো কিছুটা বর্ণনা করা হলো। আরো রয়েছে যা বিভিন্ন তাফসীরের মূলনীতি, কুরআনের আয়াতের মাঝে হেকমাহ বা আল্লাহর নীতিতেই পাবেন। আপনারা অন্যান্য স্কলারের বক্তব্য যখন শ্রবণ করবেন, তখন তারা কোন পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে সেগুলোর হিকমাহ তুলে ধরেন, সেগুলো নোট রাখতে পারেন যা ভালো ফল দেবে।
কুরআনের নাযম এর সংক্ষিপ্তসার(পূর্ণ নয় বরং কিছুতা বুঝার জন্য।)
2. একটি বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো সেকশন থাকতে পারে এবং বড় সূরাগুলোতে থাকে
3. সুতরাং কতগুলো সেকশন রয়েছে সেগুলো বের করে সেকশনগুলোর মাঝে সম্পর্ক বের করুন এবং এই সেকশন কীভাবে একে অন্যের সাথে সংযুক্ত ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে দেখুন।
4. একটি সূরার সবগুলো সেকশন-ই সূরার মূল বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত।
5. এভাবে সবগুলো সেকশন মিলেই মূল বিষয়বস্তুর পূর্ণ ভাব আসবে প্রত্যেক সূরায়।
6. একটি সূরার মূল বিষয়বস্তু পূর্বের এবং পরের সূরার মূল বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্ক রেখে ধারাবাহিকতা রাখে। সুতরাং পূর্বের, পরের এবং বর্তমান সূরার মূল বিষয়বস্তুকে চিহ্নিত করে হেদায়েত খুঁজুন।
7. এভাবে প্রত্যকেটি গ্রুপের যতগুলো সূরা রয়েছে, সবগুলোর মূল বিষয়বস্তু নিয়ে এই গ্রুপের বড় একটা টপিক বা বিষয়বস্তু রয়েছে—যাকে কেন্দ্র করে গ্রুপের সকল সূরার সকল দিক আবর্তিত হচ্ছে।
8. আয়াত, সেকশন, পূর্ণ সূরা, পূর্ব এবং পরের সূরা, গ্রুপ ====সব দিক থেকেই নাযম বা ধারাবাহিক বিন্যাস থাকে—-অর্থ, বিষয়বস্তু, প্রায়োগিক প্রজ্ঞারও এ বিন্যাস রয়েছে। সুতরাং কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন না নেওয়া। বিচ্ছিন্ন নিলেই বিন্যাসের আড়ালে যে আল্লাহর উদ্দেশিত শিক্ষা, প্রজ্ঞা ও হেদায়েত রয়েছে তাঁর ব্যত্বয় ঘটবেই—বিকৃতি এভাবেই শুরু হয়। আর সঠিকভাবে নিলে বিকৃতির বিপরীতে প্রজ্ঞা।
9. প্রত্যেকটি সূরার শুরু যেমন রয়েছে সেরুপ সমাপ্তিও রয়েছে—যত বড় সূরাই হোক না কেন। সুতরাং শুরুর সাথে শেষ হওয়ার সাথে সূরার পূর্ণতাও হয়। সুতরাং শুরুর বক্তব্যের সাথে পূর্ণতা খুঁজুন শেষের আয়াতগুলোতে।
10. কোন সূরায় একটি বিষয় ছোট্ট বা সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত আর অন্য সূরা এটাকে পূর্ণতা দেয় বা সঠিকভাবে বিস্তারিত ও পূর্ণ করে দেয়। সুতরাং জোড় এবং গ্রুপ দেখে নেওয়াই পূর্ণতার জন্য ভালো।
11. তাই একটি বিষয়কে (হোক তা আহকাম, আখলাক, বা হালাল-হারাম) চাতুর্মুখিক বা Holistic পেতে হলে একটি সূরা দিয়ে নয় বরং জোড় এবং গ্রুপের সকল সূরার ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ের সব এনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো প্রজ্ঞাপূর্ণ।
এ লেখায় যতটুকু ভুল হয়েছে তা শয়তান এবং আমার পক্ষ থেকে আর যতটুকু সঠিক এবং উপকারী তা সবই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দয়া। আল্লাহ আমার ভুলগুলোকে ক্ষমা করে শুদ্ধ হওয়ার তাওফীদ দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে এই তাফসীর থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন আল্লাহর কালামকে সঠিকভাবে গভীরতর উপলব্ধির মাধ্যমে।
Some References
2. Youtube এ কিছু ইংলিশ অডিও – https://www.youtube.com/user/tadabburiquran/videos
3. বাংলায় পূর্ণ ভূমিকা, ইতিহাস, ও পরিচিতসহ আধুনিক প্রকাশনীর দুই খন্ড (তাদের কাঁটাবনসহ যেকোন শাখায় পাওয়া যাবে) –
আমাদের বই ডট কম – থেকে
তাদাব্বুরে কুরআন ১ম খণ্ড – http://tinyurl.com/ony4jxq
তাদাব্বুরে কুরআন ২য় খণ্ড -http://tinyurl.com/ouvdnw8
রকমারী ডট কম – থেকে
http://www.rokomari.com/book/45211
4. Shaykh Abdun Nasir Jangda এর একটি উদাহরণ দেখুন –
Salah & Marriage https://www.youtube.com/watch?v=dWFdF44opPg
5. Coherence in the Quran by Ustadh Nouman Ali Khan
“We Ask Allah” Tafsir of Last Two Verses of Baqarah https://www.youtube.com/watch?v=Njuq145ESzk
6. Ustadh Nouman Ali khan তাঁর ড্রিম তাফসীরে এটি অনেক ব্যবহার করেছেন এবং উনার কুরআনের বিভিন্ন তাফসীরে এটি উল্লেখ করেন প্রচূর পরিমাণে যার অনেকগুলো রয়েছে বাইয়্যিনাহ টিভিতে –
http://www.bayyinah.tv
http://www.nakcollection.com/download-tafsir.html
7. Shaykh Akram Nadwi এই বিষয়ে শেখানো কোর্স –
Introduction to Exegesis based on Coherence in the Quran Hamīduddīn Farāhī (Muqaddimah Tafsīr Nizām al-Qur’ān)
এটি Online এও করা যাবে। বিস্তারিত তাঁর সাইটের কোর্স আউটলাইন ডাউনলোড করে দেখে নিতে পারেন। http://www.cambridgeislamicsciences.com/
http://www.cambridgeislamicsciences.com/classical-text-diploma-the-mind-boggling-coherence-in-the-quran/
8. Ustadh Hamid Ud Deen Farahi’s Introduction to Nazm al quran – http://www.javedahmadghamidi.com/books/exordium-to-coherence-in-the-quraan
https://sheepoo.wordpress.com/2009/08/29/muqaddimah-tafsir-nizam-ul-quran-contents/
9. Ph.D of Mustansir Mir on Coherence in the Quran; A study of Islahi’s Concept of Nazm In Tadabbur-i-Quran – https://yassarnalquran.files.wordpress.com/2012/07/mustansir-mir-coherence-quran.pdf
10. Ph.D of Salwa El-Awa: Textual Relations in Quran: Relevance Coherence & Structure
http://www.bookzz.org/book/882681/6775dd
11. Neal Robinson – Discovering the Qur’an: A Contemporary Approach to a Veiled Text
http://www.bookzz.org/book/1244480/70ca68
11. Raymond K. Farrin (যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন কুরআনের স্ট্রাকচার দেখে) উনার সূরা বাকারাহর উপর পূর্ণ গবেষণার ফল ও Whole Ring Compostision of Sura al Bakarah এবং দেখুন কীভাবে পূর্ণ সূরাটি সুশৃংখল গাঠনিক ডিজাইনে আছে – – Surat al-Baqara: A Structural Analysis)
http://manyprophetsonemessage.com/2014/07/19/the-remarkable-structure-of-the-quran/
12. Quran – The Linguistic Miracle (Esp. The Last Chapter)
http://www.nakcollection.com/uploads/7/7/7/4/7774039/quran-the_linguistic_miracle-linguisticmiracle.pdf
13. কুরআন গবেষণা পদ্ধতি- মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী – http://www.icsbook.info/2634/shibir
14. http://www.al-mawrid.org/
15. http://www.hamid-uddin-farahi.org/
16. http://www.amin-ahsan-islahi.com/
17. http://www.javedahmadghamidi.com
18. http://www.quranerkotha.com
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ।